ভারতচন্দ্রকে কেন নাগরিক বৈদগ্ধের কবি মনে করা হয়
ভারতচন্দ্রকে কেন ‘নাগরিক বৈদগ্ধে'র কবি মনে করা হয়?
![]() |
ভারতচন্দ্রকে কেন ‘নাগরিক বৈদগ্ধে'র কবি মনে করা হয় |
উত্তর: ভারতচন্দ্র তাঁর মঙ্গলকাব্যে সমকালীন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, মোগল-পাঠান, দিল্লী-কাশী-পুরীসহ ঐতিহাসিক স্থান, ব্যক্তিত্ব ও ঘটনা, দেবী ও কাব্যে বর্ণিত মানুষের আধুনিক জীবনবোধ, আদিরসের প্রাধান্য, জীবনমুখীন দৃষ্টিভঙ্গি, বাগবৈদগ্ধ ইত্যাদি লক্ষ করে কবি ভারতচন্দ্রকে অনেকেই নাগরিক কবি বলতে চান এবং নাগরিক জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা তাঁর কাব্যকে প্রাণহীন শব্দাড়ম্বরে পর্যবসিত করেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
ভারতচন্দ্রের জীবনকাহিনি পর্যালোচনা করেই প্রমাণ করা যায়- ভারতচন্দ্র নাগরিক ছিলেন না, ছিলেন পুরোপুরি গ্রামীণ। তিনি গ্রামেরই ধনীর সন্তান ছিলেন। কিন্তু জন্মের অল্প পরেই তাঁর পিতা বর্ধমানের রাজমাতার কোপদৃষ্টিতে পড়ে হৃতসর্বস্ব হন। কবি মাতুলালয়ে আশ্রয় নেন এবং সেখানে সংস্কৃত ভাষায় এবং পরে ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সহায়তায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৃপাদৃষ্টিতে পতিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নগর জীবনের সাথে দৃঢ় সংযোগ তাঁর ছিল না। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সংস্পর্শে আসার পরও তিনি পুরোপুরি নগরবাসী হয়ে যাননি। বরং মহারাজার নিকট গঙ্গা তীরবর্তী মূলাজোড় গ্রামখানি লাভ করে সেই গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তাকে অবশ্যই মহারাজার সভায় যেতে হতো। কিন্তু এমনি মাঝে মাঝে নগরযাত্রায় নাগরিক রুচিকে আয়ত্ত করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা যায় না।
মূলত কবির জীবনী থেকে জানা যায় তিনি নগরলালিত ছিলেন না— তিনি ছিলেন প্রখর আত্মসচেতন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সে সময় ব্যক্তির স্বতন্ত্র ইচ্ছার মূল্য স্বীকৃত না হলেও কবি তাঁর আপন ইচ্ছায় উদ্দীপ্ত ছিলেন।
তদুপরি যুগের টানাপড়েনে কাব্য রচনায় কবির অভিনব মানসিকতা লক্ষ করা যায়। নতুন জীবনবোধ, নতুন ভাবধারা, জীবনকে নতুনভাবে দেখার উল্লাস তাঁর ভাষায়, ছন্দে, কাহিনি নির্মাণে ও চরিত্রসৃষ্টিতে গতানুগতিকতাকে পরিহাসে ঔৎসুক্য করেছে।
তাই কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি হিসেবে সেকালের রুচি, পরিবেশ, বাগবৈদগ্ধ, যুক্তিবুদ্ধি, নবনির্মিত আর্থসামাজিক ও বাংলার উত্থানপতন তাঁর মঙ্গলকাব্যে স্থান করে নিয়েছে। তাই তাঁর মঙ্গলকাব্যের উজ্জ্বলতা ও কারুকার্য দেখে আপাতত মনে হতেই পারে যে, তিনি নাগরিক কবি। সর্বৈব বাস্তবতার নিরিখে মূলত তিনি মঙ্গলকাব্য ধারার শেষ গ্রামীণ কবি ।