রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটক অনুসারে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্র আলোচনা কর
রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক অনুসারে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্র আলোচনা কর
![]() |
রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক অনুসারে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্র আলোচনা কর |
উত্তর :চিরাচরিত সনাতন প্রথাধর্মের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামী উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১), 'বিসর্জন' (১২৯৭) কাব্যনাট্যটি রচিত। পুঁথিগত আচরণসর্বস্ব ধর্মের বিরুদ্ধে মানবধর্ম নামক বিশ্বধর্মের প্রতীকে একটি ধর্মকে দাঁড় করিয়ে দু'য়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে এ নাটকে। 'বিসর্জন' নাটকে যে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে, তার প্রধান প্রবক্তা রাজা গোবিন্দমাণিক্য ।“বিসর্জন' নাটকের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ এ কাহিনীকে কেন্দ্র করে যে উপন্যাস লিখেছেন তার নাম রাজর্ষি। উপন্যাসের রাজা একাধারে রাজা এবং ঋষি। গোবিন্দমাণিক্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপন্যাসের রাজারই প্রতিকৃতি।
ত্রিপুরারাজ গোবিন্দমাণিক্য নিঃসন্তান। রাজ্যের সকল প্রজাকে তিনি সন্তান জ্ঞান করেন, তাদের ভাল-মন্দ সাপেক্ষ জীবন তার। অপর্ণার কাছে রাজা জানতে পায় যে, সন্তান প্রাপ্তির আশায় রানী গুণবতী অপর্ণার সন্তানতুল্য দুটি ছাগশিশু হত্যা করেছে। এ হত্যার মধ্যে রাজা কোন মঙ্গল খুঁজে পান নি। তাছাড়া অপর্ণার বেদনা তাকে বেদনার্ত করেছে। অপর্ণার হৃদয় নিঃসৃত বাণী এক ঝলক বিদ্যুতের মত রাজার হৃদয়কে আলোকিত করে তোলে। রাজ্যে বলি বন্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এ ঘোষণায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী হতে শুরু করে এক এক করে সবাই তার প্রতিপক্ষ হয়েছে, কিন্তু সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে ওঠে তিনি অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন ঋজু ভঙ্গিতে। রাজা গোবিন্দমাণিক্য উদার সত্যধর্ম, চিরন্তন হৃদয়ধর্ম, মানবধর্মে অটল পর্বতের মত দণ্ডায়মান। তিনি মাটির তৈরি দেবী রূপ মাতৃমূর্তির পরিবর্তে মানবী অপর্ণার মাতৃরূপকেই সত্য জ্ঞান করেছেন। যে মা সন্তানের রক্তে স্নাত হতে পছন্দ করে, তার চেয়ে যে মা সন্তানের রক্ত দেখে বিচলিত ও ক্ষতাক্ত হয়, সেই মাকেই রাজা প্রকৃত মা বলে জ্ঞান করেন ।
রাজার অটল সিদ্ধান্তকে নড়াতে না পেরে রঘুপতি রাজাকে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। সত্যের প্রতীক রাজা তাতে বিচলিত হন না। বরং জয়সিংহকে তার ভুল ধরিয়ে দেন। রঘুপতি তার স্বার্থ রক্ষার্থে ভ্রাতৃহত্যায় প্ররোচিত করে রাজভ্রাতা নক্ষত্র রায়কে। ঋষিরাজ গোবিন্দমাণিক্য বিনা রক্তপাতে অনুজকে সিংহাসনে বসাতে চেয়ে রাজ্য ত্যাগ করতে বদ্ধপরিকর।
রাজা গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্র দ্বন্দ্বহীন একমুখী চরিত্র। রাজা নির্ভেজাল প্রেমের পূজারি, মানবতার প্রতীক। নিজ সন্তান কামনায় অন্যের সন্তানসম ছাগশিশু বলির মাঝে কোন কল্যাণ খুঁজে পান নি তিনি। তার মনে সন্দেহ, সংশয়, বিচার বিতর্ক নেই। একটা সৎ আদর্শ ও মহৎ নীতিকে ধ্রুবতারা করে জীবন পথে অগ্রসর হয়েছে। ঘাত-প্রতিঘাত, পারিপার্শ্বিক, এমনকি দাম্পত্য বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও অচঞ্চল ও নির্বিকার থেকে মনুষ্যত্বের আদর্শকেই অনুসরণ করেছেন। ফলে গোবিন্দমাণিক্যকে দোষগুণ সম্পন্ন মানুষ নয়, বরং মহার্ঘ ধারণার প্রতীক বলে মনে হয়।
প্রেমের পথে মুক্তি, শান্তি এটাই তার লক্ষ্য। তার দর্শন হচ্ছে হিংস্রতার পথে কখনো শান্তি স্থাপন হয় না। পশু বলি নিষিদ্ধ আইনকে বজায় রাখতে তিনি মানুষ বলির পথ অনুসরণ করেন নি। রাজার চরিত্রে দ্বন্দ্বের সুযোগ থাকলেও নাট্যকার তা কাজে লাগান নি। পরিণতিতে জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের ফলে প্রথাধর্মের ঘটে পরাজয়। রানী গুণবতী ফিরে আসে রাজার বুকে। কিন্তু প্রথাধর্মের প্রতিপক্ষ হয়ে রঘুপতির আদর্শের সাথে রাজার আদর্শের যে সংঘাত, সে সংঘাতে রঘুপতির পরাজয় ও মোহমুক্তির পূর্বেই তার স্বেচ্ছাকৃত নির্বাসনে মনে হয় এটা করার জন্যই কি নাট্যকার তাকে আগাগোড়া এমনভাবে তৈরি করেছেন? এতে দুর্ধর্ষ রঘুপতির প্রতিপক্ষ হিসেবে রাজা চরিত্রের চমৎকারিত্ব হারিয়েছে। তাকে দোষ-গুণের মানুষ না বলে বিশেষ ধারণার, সততার, মানবিকতার প্রতীক মনে হয় । তবে এটা সত্য যে গোবিন্দমাণিক্যের সততা-নিষ্ঠা-সরলতার কারণেই জয়সিংহ তার গুরুর আদর্শ বিচ্যুত হয়ে গোবিন্দমাণিক্যের মানবধর্মের জয় স্থাপনে আত্মাহুতি দিয়েছে। এখানেই গোবিন্দমাণিক্য চরিত্রের সর্বৈব সফলতা।