রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক অবলম্বনে 'রঘুপতি এর চরিত্র বিশ্লেষণ কর

রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক অবলম্বনে 'রঘুপতি এর চরিত্র বিশ্লেষণ কর  

রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক অবলম্বনে 'রঘুপতি এর চরিত্র বিশ্লেষণ কর
রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক অবলম্বনে 'রঘুপতি এর চরিত্র বিশ্লেষণ কর  


উত্তর: চিরাচরিত সনাতন প্রথা ও ধর্মের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামী উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) 'বিসর্জন' (১২৯৭) কাব্যনাট্যটি রচিত। আচরণসর্বস্ব ধর্মের বিরুদ্ধে মানবধর্মকে দাঁড় করিয়ে দু'য়ের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে এ নাটকে। নাটকের মূল দ্বন্দ্বটি ধর্মের অর্থহীন অন্ধ সংস্কার ও চিরাচরিত যুক্তিহীন প্রথাধর্মের বিরুদ্ধে নিত্য সত্য মানবধর্মের, মিথ্যা ধর্মবোধের সাথে উদার মনুষ্যত্বের, হিংসার সাথে অহিংসার । ব্রাহ্মণ পুরোহিত রঘুপতির মধ্যে এই মিথ্যা ধর্মবোধ ও অন্ধ সংস্কার তার প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে রূপায়িত। রানী গুণবতীর স্বার্থ বিজড়িত সংস্কার এবং প্রথামূলক ধর্মবোধ তার সাহায্যকারী। এর সাথে যুক্ত নক্ষত্র রায়ের রাজ্য লোভ। এ পক্ষের সমস্ত চিন্তা ও কর্ম রঘুপতির মস্তিষ্কজাত ও রঘুপতি কর্তৃক পরিচালিত ।

রঘুপতির বিশ্বাস ধর্মরক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার মত ব্রাহ্মণের ওপর অর্পিত। অন্য কেউ ধর্মরক্ষায় বাধা দিলে সে যে-কোন কিছুর বিনিময়েই ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত রাখবে। রাজার আদেশে মন্দির হতে পূজার বলি ফেরত এলে রঘুপতির তেজ, গর্ব ও দম্ভ চূর্ণ-বিচূর্ণ হল, রঘুপতির কাছে এ যেমন এক প্রচণ্ড আঘাত, তেমনি এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

আনুষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস ও ধর্মরক্ষার দায়ভারজনিত গর্ব ও অহংকার রঘুপতি চরিত্রের মৌল উপাদান। তার মর্যাদা ও আত্মসম্মান ধর্মরক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। ধর্মে আঘাত হানলে সে আঘাত তার ব্যক্তিত্বে শতগুণে বাজে। রাজা গোবিন্দমাণিক্যের সাথে দ্বন্দ্ব ধর্মে আঘাতকারীর সাথে ধর্মরক্ষাকারীর যতটা নয়, তার চেয়েও অধিক রঘুপতির আত্মরক্ষার্থে, গর্ব অহংকার ও দম্ভ রক্ষার্থে। বুদ্ধি ও সাহসে সে অসাধারণ, তেমনি উদ্দেশ্য সাধনে দৃঢ়চিত্ত, বদ্ধপরিকর ও অদ্ভুত কৌশলী। ধর্মরক্ষার নামে আপন সম্মান রক্ষার্থে সে সত্য-মিথ্যা, পাপ-পুণ্য বর্জিত বিবেকহীন পাষণ্ড।

যেদিন হতে রাজা মন্দিরে মায়ের পূজায় জীব বলি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন, সেদিন হতেই রঘুপতি ক্রোধে জ্বলে উঠল এবং তার চারিত্রিক সক্রিয়তা ও বিশেষত্ব শুরু হল। সে তার ক্রোধাগ্নি সব দিকে ছড়িয়ে, সবাইকে রাজার বিরুদ্ধে, রাজ আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলতে সচেষ্ট। রঘুপতির উন্মত্ততা ক্রমেই বেড়ে চলল। যুবরাজ নক্ষত্র রায়কে সে গোবিন্দমাণিক্যের হত্যায় প্ররোচিত করে এবং জয়সিংহকে বোঝায়-

“রাজরক্ত চাই দেবীর আদেশ।"

জয়সিংহ গোবিন্দমাণিক্যকে হত্যায় ব্যর্থ হলে রঘুপতির ক্রোধ আবার জ্বলে ওঠে। জয়সিংহকে দিয়ে সে প্রতিজ্ঞা করাতে সক্ষম হয়, তাই জয়সিংহ গুরুর কাছে প্রতিশ্রুতি

দেয়-

“আমি এনে দেব রাজরক্ত শ্রাবণের শেষ রাত্রে-

দেবীর চরণে।”তাতেও রঘুপতি শান্ত নয়, তারই চক্রান্তে মন্দিরের প্রস্তর নির্মিত জড় প্রতিমার মুখ ফিরে যায় এবং সমস্ত ধর্মভীরু প্রজার মনে ভীতি ও শঙ্কা সৃষ্টি হয়। তার সক্রিয়তা নিরন্তর চরিত্র তার একমুখীন— একমাত্র মন্দিরের পূর্ণ ক্ষমতা হস্তগত করা। রাজা রাজ্যের অন্যত্রের শাসক হলেও মন্দিরের একচ্ছত্র শাসন অধিকার তারই। সে তার অভিপ্রায় চরিতার্থে অবিচল, নিঃশঙ্ক, নিরন্তর সচেষ্ট। সে বিচলিত হয়েছে মাত্র একবার- রাজহত্যার চক্রান্তে লিপ্ত থাকায় তার আট বছর নির্বাসন দণ্ড হলে। দু'দিন পরই নির্বাসনে যেতে হবে। তার বুকের মধ্যে পরাজয়ের জ্বালা হু হু করে জ্বলতে থাকে। সে বিভ্রান্ত বিচলিত— গেছে গর্ব, গেছে তেজ, গেছে ব্রাহ্মণত্ব। কিন্তু তবুও সে হাল ছাড়ে নি। পুত্রতুল্য জয়সিংহের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। শিষ্য জয়সিংহ তাকে কথা দিয়েছে শ্রাবণের শেষ রাতে রাজরক্ত এনে দেবে, তাই সে শ্রাবণের শেষ রাত পর্যন্ত অর্থাৎ দু'দিন সময় চেয়ে নেয়। অন্তরের হিংসা বহ্নি তার দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। “রাজ রক্ত চাই দেবীর”- এত বড় ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও একথা সে ভোলে নি। তাই মন্দিরের সামনে এসে ভক্ত জয়সিংহকে তৃতীয়বারের মত প্রতিজ্ঞা করালেন, জয়সিংহ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে-

“রাজরক্ত চাহে দেবী, তাই তারে এনে দিব।”

মন্দিরের বাইরে ঝড় উঠেছে, সর্বনাশের ঝড়। এ ঝড়ে হয় রাজা, না হয় রঘুপতি শুকনো পাতার মত উবে যাবে। কিন্তু না, বিশ্বাসের পাথরে খোদাই করা তার চোখ, ধর্ম বিশ্বাসে। শেকড় তার দীর্ঘদিনে কঠিন মাটিতে প্রোথিত। পূজোপকরণ নিয়ে রঘুপতি মন্দিরে প্রবেশোন্মুখ, ঝড়ের উন্মত্ততা তার নিজের মধ্যেও হিংস্র উন্মত্ততা জাগিয়ে তুলেছে। একসময় অপর্ণা জয়সিংহের অন্বেষণে এসে উপস্থিত। রঘুপতি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়েছে-

“দূর হ এখান হতে

মায়াবিনী! জয়সিংহে চাহিস কাড়িতে দেবীর নিকট হতে, ওরে উপদেবী!

জয়সিংহ মন্দিরে প্রবেশ করতে না করতেই রঘুপতি জিজ্ঞাসা করে- “রাজরক্ত কই।” নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে জয়সিংহ বলেছে-

“রাজরক্ত আছে দেহে।

এই রক্ত দিব। এই যেন শেষ রক্ত হয় মাতা।”

জয়সিংহকে হারিয়ে রঘুপতি এতদিনে চৈতন্য লাভ করেছে। পাষাণের স্তূপ দেবীকে জলে নিক্ষেপ করে মানবী দেবী অপর্ণার হাত ধরে মন্দির ছেড়েছে।

রঘুপতির চরিত্রের বীজ সামন্ত সমাজের গভীর মৃত্তিকায় প্রোথিত। ক্ষমতা, অর্থবিত্ত, লোভ তাকে উন্মত্ত করেছে। তার জ্বালাময়ী লালসার লেলিহান শিখায় পুড়ে যায় তারই সন্তানতুল্য শিষ্য। রঘুপতির লোভের ঝড় থামাতে জয়সিংহকে বুক পেতে দিতে হয়েছে। রঘুপতি নিষ্করুণ ক্রুর কিন্তু কুটিল নয়। তার বিশ্বাস ভুল পথে পরিচালিত হলেও সে নিজেকে কখনো বঞ্চনা করে নি- সে বিশ্বাস করে যে, দেবী বলি চায়, জীব রক্ত ছাড়া তার তৃষ্ণা মেটে না। এটাই আজন্মের সংস্কার, এই সংস্কারের জালের মধ্যে নিজেকে বন্দী রেখে সে সার্থকতা লাভ করে। শান্তি চায়। ব্রাহ্মণ্যের গর্বে সে প্রদীপ্ত, ব্রাহ্মণত্বের অপমান, তার ক্ষমতা হ্রাস তিলমাত্রও সে সহ্য করে না, নিজের ও দেশের চিরায়ত আচার ও সংস্কারকে কিছুতেই সে ক্ষুণ্ণ হতে দেবে না, যত কঠোরই হোক রাজার আদেশ। সে কিছুতেই কর্তব্য বিচ্যুত হবে না, তাই রাজার বিরুদ্ধে তার চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র। প্রচণ্ড গর্ব তার, এই গর্বের কারণেই সে রাজার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে, বার বার পুত্রতুল্য শিষ্যকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় রাজরক্তের জন্য। এই গর্বের কারণেই মানব হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ-প্রীতি-দয়া-মায়া- ভালবাসাকে উৎখাত করে সমস্ত জীবনটাকে শুধু একটা ধূ-ধূ তৃষ্ণার্ত মরুভূমি করে তোলে। সত্য-মিথ্যা-পাপ-পুণ্য সবই তার অগোচরে। কিন্তু আত্মাভিমান ও জাত্যাভিমানের কাছে সব খর্ব হয় । সত্য হয়ে যায় মিথ্যে, মিথ্যে সত্যের মুখোশ পরে। পাপ-পুণ্যের ভেদাভেদ থাকে না, শুধু মাথা উঁচু করে থাকে প্রচণ্ড নিষ্করুণ অহং। এই আত্মাভিমানের নিষ্করুণতার মাঝেও জয়সিংহের প্রতি রয়েছে তার অকৃত্রিম স্নেহ ও দুর্বলতা। অপর্ণা প্রেম দিয়ে জয়সিংহকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেবে বলে সে অপর্ণাকে সহ্য করতে পারে না। জয়সিংহের প্রতি ভালবাসা রঘুপতির ছলনা নয় ।1

রঘুপতি কোন সত্যের প্রতিমূর্তি নয়, তার জীবন নানা ঘটনায় আবর্তিত ও বিবর্তিত সনাতন ধর্ম ও আচারের প্রতি তার অবিচল নিষ্ঠা, একটা প্রচণ্ড আত্মাভিমানের দীপ্তি, একটা প্রদীপ্ত প্রতিভার সুতীক্ষ্ণ যুক্তি কৌশল যার সামনে বার বার জয়সিংহের চিত্ত আন্দোলিত হয়ে মাথানত করেছে। রঘুপতির মুখ দিয়ে তার কৃতকর্মের পক্ষের যুক্তি যেন ছুরির ফলার মত ঝলসে ওঠে, রঘুপতির যুক্তি কোথাও কারও কাছে হার মানে না। একটা অহংকার, ক্ষমতার লোভ ও দম্ভ আশ্রয় করে রঘুপতির সব কর্ম ও চিন্তা নিয়ন্ত্রিত, সেই অহংকারের মধ্যে সে আকণ্ঠ ডুবেছিল, সেখান থেকে সব রস ও পানীয় সংগ্রহ করে তার জীবন অতিবাহিত করেছে। কিন্তু জয়সিংহের আত্মবলিদানের আঘাতে তার আশ্রয়স্থল ধ্বসে গেছে, হৃদয় হয়েছে ফাটলে ফাটলে চৌচির। তার জীবনের নিয়ামক শুকিয়ে যায়, ফলে সে নিজেকে নিঃস্ব, অসহায় ও অনিকেত বোধ করে। এই একবার মাত্র রঘুপতি চরিত্রের বিশেষ দিক উঁকি দিয়েছে। জয়সিংহকে উদ্দেশ্য করে বলেছে—

“বস মোর, হে গুরুবৎসল!

ফিরে আয়, ফিরে আয়, তোরে ছাড়া আর

কিছু নাহি চাহি!”

নাটকের শেষে তার সমগ্র জীবনের একান্ত পরাজয়ের মধ্যে তার চরিত্রের তেজোদীপ্ত গর্বটুকু একেবারে ধুলায় মিশে গেছে, মানসের হয়েছে পরিবর্তন। সে পরাজিত হয়েছে সেখানে, যেখানে বুদ্ধির মধ্যে জীবনের চরম সত্যকে খুঁজে পাওয়া যায় না, চরম সত্যকে খুঁজে পায় পরম আঘাতের ভিতর দিয়ে।

তার চরিত্রে সক্রিয়তা যেমন ভোগও তেমনি। সে-ই শ্রেষ্ঠ sufferer। রঘুপতির পরিণতি, রিক্ততা, অন্তর্জালা দৃশ্যময় নয়, বরং একেবারে মনের গভীরতম অনুভূতির মধ্যে নিহিত। তার পরিণতি 'সুরের মধ্যে ধ্বনিত, অনুভূতির মধ্যে অনুরণিত। জয়সিংহের মৃত্যুতেই তার আত্ম-উদ্বোধন ।

জয়সিংহের নির্মম আত্মদানে স্তব্ধ হয়ে যায় রঘুপতি। তার চৈতন্যের ঘটে পরিবর্তন। মিথ্যে মনে হয় দেবীর আরাধনা, শূন্য মনে হয় মন্দিরপীঠ। তার বোধিতে ধরা পড়ে- মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের বাস, প্রাণই মূল্যবান, পাষাণ মূর্তি অর্থহীন। তাই রঘুপতি বিসর্জন দেয় পাষাণ প্রতিমাকে, তার চৈতন্য থেকে বিসর্জিত হয় হিংসা, গর্ব, অহংকার — রক্ত। রঘুপতি বলক্ষয়, শক্তিক্ষয় ও অন্তরক্ষরণে ঋদ্ধ। রঘুপতি বিজয়ী চরিত্র- কারণ তারই হাতে গড়া শিষ্য মৃত্যুর মহিমায় তার নবজীবনকে অনাবিষ্কৃত জীবনকে আবিষ্কার করেছে। এ নাটকে গৌরব-অগৌরব, বিজয়-বিজিত, দর্প-অহংকার-দর্পচূর্ণ-হিংসা-প্রেম এমনি বিবিধ উপকরণের সমন্বয়ে রঘুপতি চরিত্রটি বিশেষ মর্যাদায় মণ্ডিত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ