রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন' নাটকের নামকরণের সফলতা আলোচনা কর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন' নাটকের নামকরণের সফলতা আলোচনা কর
![]() |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন' নাটকের নামকরণের সফলতা আলোচনা কর |
উত্তর: শিল্পের নামকরণ বিশেষ ধরনের আর্ট। সফল নামকরণের মধ্য দিয়ে দর্পণের মত শিল্পের মূল উপজীব্য প্রতিবিম্বিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুল পঠিত ও আলোচিত শিল্পসফল কাব্যনাট্য 'বিসর্জন' তাঁরই ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস 'রাজর্ষি'র কাহিনীর নাট্যরূপ। তবে নাটকের তাগিদে কাহিনীর আঙ্গিক ও চরিত্রে এসেছে প্রয়োজন অনুগ পরিবর্তন। সে ক্ষেত্রে উপন্যাসের নাম রাজর্ষি রাখা হয়েছিল রাজা গোবিন্দমাণিক্যের ঋষি ও রাজ চরিত্রের কারণে। নাটকে গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্র ও উপন্যাসে রাজ-চরিত্রের তেমন বদল না হলেও রাজর্ষি নামকরণটির মধ্যে তেমন নাটকীয়তার গন্ধ না থাকায় নাট্যকার নামকরণটিকে বর্জন করেছেন।
লক্ষণীয় যে, নাটকে বারবারই উচ্চারিত হয়েছে শ্রাবণের শেষ রাত। যেমন- নাটকের নায়ক চরিত্র জয়সিংহ তার গুরু রঘুপতিকে আশ্বাস দিয়েছে শ্রাবণের শেষ রাতে ঈন্সিত রাজরক্ত এনে দেবে। সাজাপ্রাপ্ত রঘুপতি রাজার কাছে দুটি দিন ভিক্ষে চেয়েছে— তার লক্ষ্য ছিল শ্রাবণের শেষ রাত। তদুপরি নাটকের নামকরণ শ্রাবণের শেষ রাত হলে নাট্য ও কাব্যধর্মিতাও ক্ষুণ্ণ হত না। কিন্তু একটু সতর্ক দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, শ্রাবণের শেষ রাতে অন্ধকারে মন্দিরে রঘুপতি জয়সিংহের জন্য উদ্গ্রীবভাবে প্রতীক্ষারত— তার বিশ্বস্ত শিষ্য জয়সিংহ রাজরক্ত নিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবত শ্রাবণ বর্ষণ যেমন পৃথিবীর সব ক্লেদাক্ততা ধুয়ে মুছে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি জয়সিংহের এত দিনের দ্বন্দ্বের হয়েছে অবসান। সে রাজরক্তের পরিবর্তে নিজের রক্ত দিয়ে হিংস্রতা পঙ্কিলতাকে নিঃশেষে ধুয়ে শুভ্র শুচি করে তুলেছে। এবং রক্তপানপুষ্ট মূঢ় দেবী প্রতিমাকে গোমতীর জলে বিসর্জন দিয়েছে। এখানেই নাটকের বিসর্জন নামকরণের সূত্রপাত ঘটে ও নাটকের মূল প্রোথিত প্রত্যয় ব্যঞ্জিত হয়।
কাহিনীতে ত্রিপুরা রাজ্যের রানী সন্তান কামনায় দেবীর নামে জীববলি দেওয়ায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অপর্ণার সন্তানতুল্য ছাগশিশু দিয়ে সেই প্রতিজ্ঞা পূরণকালে অপর্ণা রাজার কাছে বলিপ্রথার বিরুদে প্রতিবাদ জানায়। প্রেমধর্মে বিশ্বাসী রাজা বলিদানের অকল্যাণ রোধে রাজ্যে বলিদান নিষেধ করে দেয়। দেবীভক্ত প্রচলিত প্রথাধর্মে বিশ্বাসী রাজ পুরোহিত রঘুপতি রাজারআদেশে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সহযোগী শক্তি হিসেবে সন্তান কামনায় অন্ধ রানী গুণবতী ও রাজ্যলোভী নক্ষত্র রায় রাজার বিরুদ্ধাচরণ করে।
রাজা ও পুরোহিতের সংঘাতের মাঝখানে পড়ে রঘুপতির শিষ্য রাজপুত তনয় মানবতাবাদী জয়সিংহ এক মর্মান্তিক মানসিক দ্বন্দ্বে উপনীত হয়। একদিকে গুরুর বাক্য, অন্যদিকে প্রেমধর্ম। সে শেষ পর্যন্ত নিজের রক্ত প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। জয়সিংহের আত্মত্যাগে রঘুপতির সম্বিত ফিরে আসে, নদীবক্ষে বিসর্জন দেয় নির্বাক নিস্তব্ধ পাষাণ প্রতিমা। নাটকের নামকরণে আমরা যদি বাৎসল্য প্রীতি বিশ্লেষণ করি তাহলে ধরা পড়ে যে, নিঃসন্তান রানী সন্তান কামনায় উদ্গ্রীব। তাই সে দেবীর পায়ে অন্য প্রাণ প্রদানে প্রতিজ্ঞ । মাতৃত্বের পিপাসায় সে অন্ধ। ফলে প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ— এদিকটি তার চোখে পড়ে না। সে হয়ে ওঠে সন্তান প্রত্যাশায় একমুখীন। অন্যদিকে রঘুপতির াব তেজ তারা থেকে উদারায় নেমে আসে সন্তানসম জয়সিংহের মৃত্যুতে। সন্তানসম ছাগশিশু বলি দেওয়ায় অপর্ণা হয়ে ওঠে প্রায় পাগলিনী। এদিক বিবেচনায় নাটকের নামকরণে একবার বাৎসল্য প্রীতির কথা আমাদের মনে উঁকি দেয়। কিন্তু তা রানীর সন্তান কামনার মত একদেশদর্শিতায় হয়ে ওঠে সীমিত, সংকীর্ণ ।
নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়— প্রেম ও হিংসার সংঘাতে প্রেমের জয়। সেদিক দিয়ে 'প্রেম' বা 'হিংসা' নামকরণে সর্বৈব শিল্প সফলতা আসে না। অপর্ণার ছাগশিশু বলিদান নাটকের বিরোধী স্রোত, যা রানীর সন্তানপ্রীতিকে স্ববিরোধী করে তুলেছে এবং জয়সিংহের আত্মবলি, যা রঘুপতির অনাবিষ্কৃত সত্যকে আবিষ্কৃত করেছে। সেদিক থেকে নাটকের নাম 'বলিদান' ব্যবহার করলে তাতে নাটকের মূল প্রত্যয়ের বৃহদত্ব ক্ষুণ্ণ হত।
কিন্তু মূল, জয়সিংহ চরিত্রের যে সংঘাত ততই সার্বজনীন মানবের সংঘাত। একদিকে প্রেমের আহ্বান পক্ষান্তরে যুগ-যুগান্তরের প্রথা অবিচল ভক্তির মাদকীয় ইশারা। যে দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে জয়সিংহ, দ্বন্দ্ব নিরসন ঘটেছে জয়সিংহের আত্মবিসর্জনে। প্রেম তাকে হাতছানি দিলেও গুরুর কাছে দেয়া প্রতিজ্ঞা তাকে কম যন্ত্রণা দেয় নি। তাই মৃত্যু ভিন্ন এ দ্বন্দ্ব থেকে পরিত্রাণের কোন পথ জয়সিংহের ছিল না। ফলে নাটক হয়ে উঠেছে ট্র্যাজিক । জয়সিংহ কেবল আত্মবিসর্জনই দেয় নি, তারও আগে অপর্ণাকে বিসর্জন দিয়েছে।
জয়সিংহের আত্মবিসর্জন নাটকের গ্রন্থি মোচনের, দ্বন্দ্ব নিরসনের সূতিকাগার। যে বিসর্জনের ফলে হিংস্র রঘুপতি এক উল্লম্ফনে দীর্ঘদিনের লালিত প্রতিমাকে দিয়েছে সলিলে বিসর্জন। প্রতিমা বিসর্জন নাটকের বাহ্যিক ঘটনা মাত্র। যা আমাদেরকে টেনে নিয়ে যায় নাটকের পাত্র-পাত্রীর হৃদয় দোরে। এবং চৈতন্যের গভীরে আলো ফেলে আমাদের দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন করে। আমরা দেখতে পাই রঘুপতির পুত্রতুল্য জয়সিংহ হীন শূন্য হৃদয়। যে রঘুপতির দীর্ঘদিনের লালিত ভক্তি, আত্মঅহমিকা, গর্ব, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিংস্রতার পথকে প্রশস্ত করেছে, অন্যান্য চরিত্রকে করে তুলেছে হিংস্র। সেই রঘুপতির মন থেকে বিসর্জিত হয়েছে হিংস্রতা- প্রেমের অনুভূতি সেখানে দানা বেঁধেছে। চির ঘৃণ্য অপর্ণার হাত ধরে চির লালিত মন্দির ত্যাগ করেছে।
সহযোগী হিসেবে রানীর মন থেকেও হিংসা, স্বার্থপরতা দূর হয়েছে। উপলব্ধি এসেছে— যে মাতৃত্ব তার কাম্য তার জন্য অন্য মায়ের কোল শূন্য করবার মত ঘটনার মধ্যেকার অকল্যাণবোধ। রানী গুণবতীও অবশেষে রাজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সকল গোঁড়ামিকে বিসর্জন দিয়ে। প্রেমের মধ্যেই মুক্তি— এ বোধ তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
যে পাষাণকে লোকে দেবী বলে জানত, মানত এবং ভক্তি করত, তার হয়েছে বিসর্জন। তদস্থলে মানব দেবীর ঘটেছে আগমন, গেছে পাপ। দেবী আজ এসেছে ফিরিয়া আমার দেবীর মাঝে ।
উহ্য থাকলেও আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে নক্ষত্র রায়ের মধ্যে রাজ্যলোভের যে মোহ জন্মেছিল, সে মোহও বিসর্জিত হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্বের হয় বিসর্জন।
সে
নাটকের শৈল্পিক উপধার মধ্যে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যেভাবে মূর্ত হয়েছে— দিক বিবেচনায় 'বিসর্জন' নামকরণই হয়েছে সর্বৈব সফল ও ব্যঞ্জনাবহুল। শিশির বিন্দুতে প্রোথিত সূর্যের মত 'বিসর্জন' নামের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে নাটকের অনুপুঙ্খ বিষয় ভাবনা ।