রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক কি মেলোড্রামা না ট্র্যাজেডি তোমার অভিমতের পেছনে যুক্তি দাও

রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক কি মেলোড্রামা না ট্র্যাজেডি তোমার অভিমতের পেছনে যুক্তি দাও 

রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক কি মেলোড্রামা না ট্র্যাজেডি তোমার অভিমতের পেছনে যুক্তি দাও
রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটক কি মেলোড্রামা না ট্র্যাজেডি তোমার অভিমতের পেছনে যুক্তি দাও


উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন' নাটক ট্র্যাজেডি না মেলোড্রামা? এর মীমাংসায় প্রথমেই ট্র্যাজেডি ও মেলোড্রামা বলতে কী বুঝায় তা পরিষ্কার করা দরকার।

নাটকের পরিণতিতে পাত্র-পাত্রীর Suffering যখন শিল্পের আঙ্গিনা ছেড়ে পাঠক ও দর্শককে সিক্ত করে অথবা নাটকের ভূমিকায় কোন চরিত্র নিয়তির করাল গ্রাসে বা নিজ কর্মে-অন্তর্দ্বন্দ্বে পতিত হয়ে- ক্ষতাক্ত ও বেদনায় সিক্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে ট্র্যাজেডি বলা যেতে পারে। তবে নিছক মৃত্যু ট্র্যাজেডি নয় ।

নাটকে যতটুকু নাটকীয়তা থাকতে পারে তারও অধিক বা কার্যকারণের ইঙ্গিত প্রদান না করে কোন আকস্মিক ঘটনা নাটকের গতিকে পরিবর্তন করলে তাকে মেলোড্রামা বলে । ‘বিসর্জন' নাটকের কাহিনীর সূত্রপাত বলিদানের মাধ্যমে। রানীর সন্তান কামনায় দেবীর তুষ্টিতে ছাগশিশুর বলিদান। ছাগশিশুর প্রতিপালিকা অপর্ণা এ ধরনের প্রাণিহত্যায় বাধ সাধে। রাজার বোধোদয় ঘটে – বলিদান বন্ধের ঘোষণা হয়। মন্দির পুরোহিত রঘুপতি তা মেনে নিতে পারে না বলেই ষড়যন্ত্র শুরু হয় রাজার বিরুদ্ধে। তারই পোষ্য শিষ্য জয়সিংহকে কাজে লাগাতে চায় ।

দ্বিধাগ্রস্ত জয়সিংহ গুরুর ঋণ শোধ করতে প্রতিশ্রুতি দেয়— শ্রাবণের শেষ রাতে রাজরক্ত এনে দেবে। গুরুর প্রহসন ধরা পড়ায় জয়সিংহের আবাল্য বিশ্বাস টুটে যায়। জয়সিংহের বিশ্বাস টুটে যাওয়া কি মেলোড্রামা? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার চরিত্রের মৌল উপাদান প্রেম। সৈ সরল, অকপট। অপর্ণার কৈফিয়ত তার সুপ্ত মানবতাকে জাগিয়ে তুলেছে। অপর্ণার আহ্বানে সে সহজে সাড়া দেয় নি। শিল্পী তার মনে প্রোথিত বিশ্বাসের জট ধীরে ধীরে উন্মোচন করেছেন। তার সামনে একদিকে মানবতার ডাক, অন্যদিকে আবাল্য বিশ্বাস। সে ক্ষতাক্ত হয়েছে। ফলে তার কাছে একসময় সবকিছু শূন্য মনে হয়েছে। কিন্তু সে যখন বুঝতে পেরেছে দেবী রাজরক্ত চায় না, এটা মূলত রঘুপতির প্রহসন। তখন তার দ্বিধা ঘুচে যায়। কিন্তু তখনো তার মনে রয়ে যায় কৃতজ্ঞতাবোধ। তাই গুরুর চাওয়াকে সফল করতে গুরুকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে শ্রাবণের শেষ রাতে নিজের রক্তই সে গুরুর পাদপদ্মে নিবেদন করে। এছাড়া তার কোন উপায় ছিল না। তবে এর পূর্বাভাস শিল্পী অনেক জায়গায়ই উল্লেখ করেছেন। এমনকি রঘুপতির দণ্ড হওয়ার পরেও সে রাজার কাছে সময় ভিক্ষা চেয়েছে শুধু এ কারণেই। সুতরাং জয়সিংহের আত্মহনন মেলোড্রামাটিক নয়, কার্যকারণ সম্পর্কিত।

রঘুপতি প্রথাধর্মের রক্ষক। তার মানসবদলকে অনেকেই মেলোড্রামা বলতে চান। কিন্তু ধ্রুবকে হত্যা করবার জন্য আনা হলে রঘুপতির চোখে ভাসে অতীতের দৃশ্য। তার মনে জাগে জয়সিংহের বাল্য-কাহিনী। জন্মে অপত্যবোধ। ফলে জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতির স্বার্থান্ধতা, লোভান্ধতা ঘুচে যায়। তার উপলব্ধিতে আসে অপর্ণার ছাগশিশু হারাবার ব্যথা। পিতা হিসেবে সে বুঝতে পারে সন্তান বধের বেদনা। ফলে সে বলিদানকে বন্ধ করে, দেবীকে জলে নিক্ষেপ করে— অপর্ণার মিছিলে সামিল হয়। অপর্ণা হয়ে ওঠে জয়সিংহের বিকল্প । রঘুপতির চৈতন্যের বদল অপত্যবোধের ছায়ায় লালিত। সুতরাং শিল্পী হঠাৎ করে নয়, বরং কার্যকারণ সম্পর্কের ওপর তার বদলকে দেখিয়েছেন।

'বিসর্জন' নাটকের শুরু একধরনের শূন্যতা ও নিঃসঙ্গতা দিয়ে— রানীর করুণ আর্তনাদে । দেবীর কাছে সন্তান ভিক্ষা। পরবর্তী স্তরেই অপর্ণার বেদনাবিধুর মুখ আমাদের চোখে পড়ে। তারও ছাগশিশু রূপ সন্তান হারানোর গুমরানো ব্যথা। যা রাজা জয়সিংহ এমনকি

আমাদেরকেও বেদনাতুর করে ।

রঘুপতি ও রানীর সঙ্গে শুরু হয় অপর্ণা ও রাজার দ্বন্দ্ব। আর এ দ্বন্দ্বের মাঝখানে জয়সিংহ পিষ্ট হয়। জয়সিংহের প্রতিপালক ও গুরু রঘুপতি। আবাল্য সে হত্যাযজ্ঞে বিশ্বাসী ও অভ্যস্ত। কিন্তু তার মধ্যেকার সুপ্ত প্রেমিক ও মানবিক বৃত্তিকে ছুঁয়ে যায় অপর্ণার আর্তনাদ । সে পতিত হয় উভয় সংকটে, দ্বন্দ্বে ।

শূন্য মনে হয়। তার গুরুর ষড়যন্ত্রে রাজাকে হত্যা করার দায়িত্ব পর্যন্ত তাকে নিতে হয়, দ্বন্দ্বে ক্ষতাক্ত জয়সিংহের সঙ্গে আমরাও ঐক্য ঘোষণা করি। একসময় তার কাছে সবকিছু অথচ ইতোমধ্যে সে হত্যাকে, রক্তকে ঘৃণা করে। গুরুর প্রহসন ধরা পড়ায় প্রথাধর্মে দেবীতে, গুরুতে তার বিশ্বাস ভাঙে। কিন্তু মানবতার সঙ্গে সততা জড়িত, জড়িত বামে, তার মধ্যে থাকে কৃতজ্ঞতাবোধ ।

ফলে তার গুরুকে দেয় প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে। হয়। অপর্ণার কারণেই তাকে ছেড়ে যেতে হয় অপর্ণাকে। অপর্ণার ইচ্ছে বলি বন্ধ করা। তা করতে সে নিজেই বলির শিকার হয়, যাতে বলি বন্ধ হয়। মৃত্যু ট্র্যাজেডি নয়, কিন্তু জয়সিংহের মহৎ আত্মদান আমাদেরকে বেদনার্ত ও সিক্ত করে। তার আত্মহননের বীজ তার চরিত্রেই নিহিত ছিল- তা হচ্ছে মানবতা, সরলতা, কৃতজ্ঞতা, প্রেমিক ।

যে গেল সে তো গেলই, কিন্তু রঘুপতি? তার বিশাল বিশ্বাস ধ্বসে পড়ল। কারণ জয়সিংহ তার পালিত পুত্র ও শিষ্য। এতদিন সে বুঝতে পারে নি রক্তপানের বেদনা। কিন্তু জয়সিংহের মৃত্যুতে তার পিতৃহৃদয় হয় ক্ষতাক্ত। তারই পাতানো জালে সে ধরা পড়েছে। বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে রঘুপতির বুকে। ফলে সর্বগ্রাসী রক্তনেশায় মত্ত রঘুপতির বেদনাবিধুরতা 'বিসর্জন' নাটকের ট্র্যাজেডিত্বকে আরও ঘনীভূত করেছে।

উপসংহারে বলা যায়- 'বিসর্জন' নাটক কোনভাবেই মেলোড্রামা নয়। যতটা নাটকীয়তায় নাটক নাটক হয়ে ওঠে তার বেশি কোন আকস্মিকতা এখানে নেই। যে ঘটনাকে আকস্মিক মনে হয় তা কার্যকারণে পুষ্ট। বরং জয়সিংহের তাৎপর্যমণ্ডিত আত্মহনন ও রঘুপতির শূন্য পিতৃত্বের হাহাকারে নাটকটি হয়ে উঠেছে ট্র্যাজেডি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ