নবীবংশ কী আলোচনা কর

নবীবংশ কী? আলোচনা কর।

নবীবংশ কী? আলোচনা কর।
নবীবংশ কী? আলোচনা কর।

উত্তর: মুসলমান কবিগণ এক বিরাট জীবনী সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। প্রচলিত জীবনচরিত বলতে যা বুঝায় এগুলো তেমন নয়। রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ও চৈতন্যচরিতগুলোর অনুসরণে এগুলো রচিত। নবীবংশ এই জীবনী সাহিত্য বা চরিত কথার অন্তর্গত সাহিত্য।

নবীবংশ মহানবী (স) সহ অন্য নবীদের ধর্ম জীবনকে সত্যমিথ্যার মোড়কে, অলৌকিকত্বের স্পর্শে মহিমান্বিত করা হয়েছে। এতে নবীর জীবন ও ইসলামের কিছু অপব্যাখ্যাও রয়েছে। উদ্দেশ্য ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব প্রকাশ।

চট্টগ্রামের অধিবাসী সৈয়দ সুলতান ১৫৮৪-৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবীবংশ রচনা করেন। এতে মূলত নবীকাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের কারোর বংশধরের বর্ণনা নয়। নবীবংশে মূলত বাঙালি কবি আরব দেশের চিত্রাঙ্কনে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাকেই তিনি আরব বলে চালিয়েছেন। 

পড়ুয়া ও শ্রোতাদের আরব সম্পর্কিত ধারণা না থাকায় কাহিনীর আবেদন বা কাব্যরস কোথাওঁ ব্যাহত হয় নি। আবার নবীদের সম্বন্ধে কাহিনীগুলোও সব কাল্পনিক । অবশ্য এগুলো সৈয়দ সুলতানের বানানো নয়, তাঁর পূর্বে হাজার বছর ধরে ওসব কাহিনী লোকপরম্পরায় তৈরি ও পল্লবিত হয়ে আসছে। 

তবে পূর্বে রচিত আরবি-ফারসি নবীকাহিনীকে আদর্শ করে সৈয়দ সুলতান স্বাধীনভাবে তাঁর নবীবংশ রচনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের পটভূমিকায় এঁদের জীবনচিত্র এঁকেছেন।

যে দেশজ মুসলিম সমাজ গ্রামে-গঞ্জে গড়ে উঠেছে, ইসলামী ইতিকথায় ও ঐতিহ্যে সে সমাজকে দীক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছে কবির নবীবংশ। 

পরাগলী মহাভারতই কবিকে এসব দায়িত্ব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। সৈয়দ সুলতানই প্রথম ব্যক্তি যিনি সাহস করে নবী-রসুলের ইতিবৃত্ত এবং ইসলামের মর্মকথা বাংলা ভাষায় রচনা করতে শুরু করেন।

যে রূপে আদম হাওয়া সুজন হৈল

যে রূপে যথেক পয়গাম্বর উপজিল। বঙ্গেতে এসব কথা কেহ না জানিল। নবীবংশ পাঞ্জালীতে সকল কহিল।

'নবীবংশ' রূপ জ্ঞানদর্পণ সৃষ্টি করে কৃতার্থ কবি সগর্বে দাবি করেছেন-

মাত্র বাপে তোহ্মারে জনম দিয়া গেছে,

দিব্য আঁথি তোহ্মারে দিলাম আন্ধি পাছে।

নবীবংশ রক্ষণ পঠনের যৌক্তিকতা ও সুফল সম্বন্ধে কবি বলেন-

যে সকল মুমীন হএ করুণা হৃদএ নবীবংশ পুস্তক রাখিতে জুয়াএ। এ হি পুস্তক যদি পারে রাখিবারে আল্লার গৌরব হৈব তাহার উপরে।

তাঁর মতে সর্বশেষ ধর্ম ইসলামই হচ্ছে সর্বজনগ্রাহ্য ও বরেণ্য ধর্ম। কবি ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিকৃতিজাত অসারতা ও পরিহার্যতা যুক্তি প্রমাণ যোগে এ গ্রন্থে প্রতিপন্ন করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর নবীবংশ চট্টগ্রামের মুসলমানের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

মুসলমানদের সাধারণ বিশ্বাস এক বা দুই লাখ নবী পয়গম্বর রয়েছেন। এঁদের মধ্যে নাম জানা বিশ-পঁচিশ জন এবং কেতাবী নবী চারজন, অন্যেরা স্বপ্নাদিষ্ট নবী। নবীবংশে কবি আদম থেকে ঈসা পর্যন্ত মাত্র আঠারোটি কিসসা বা নবীকাহিনী বর্ণনা করেছেন-

সৈয়দ সুলতান পঞ্চালী ভবিল

অষ্টাদশ কিসসা নবী সমাপ্ত হৈল।

দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগে প্রথম পর্বের শেষে বলেছেন-

এবে শুন যে রূপে জন্মি মুহম্মদ

শুনিলে সেসব কথা খণ্ডিব আপদ ।

নবীবংশের 'হামদ' খণ্ডে আল্লাহর স্বরূপ ব্যাখ্যার চেষ্টা আছে। 'নমরূদ ইব্রাহিম' বৃত্তান্ত নবীবংশ কাব্যের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রধান বৃত্তান্ত। এর আর একটি প্রধান ও দীর্ঘতর অংশ হচ্ছে মুসা ফেরাউনের কিসসা। তারপর দাউদ ইসমাইল কিসসা, হারুত মারুতের প্রিয় ও পরিচিত কাহিনী, অতঃপর জাকারিয়া নবী ও ঈসা নবীর কিসসা।

কবি মানুষকে সৎ জীবনে প্রবর্তনা দানের জন্য শ্রমসাধ্য জ্ঞানপুষ্ট ও সুবৃহৎ কলেবরে নবীবংশ রচনা করেছেন। প্রাচীন শাস্ত্রীয় জ্ঞান ছাড়াও তিনি সমকালীন জ্ঞান, আপ্তবাক্য, নীতি আদর্শ, রীতি রেওয়াজ, তত্ত্ব তথ্য প্রভৃতি সযত্নে প্রয়োগ করেছেন। 

আদর্শ লোকশিক্ষকের ভূমিকা কবি যোগ্যতার সাথেই পালন করেছেন। মধ্যযুগের চরিতকাব্যে নবীবংশ এক অনবদ্য সংযোজন।

সৈয়দ সুলতান রচিত নবীবংশ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড হচ্ছে রসুল মুহম্মদচরিত। এ খণ্ডে তিনটি পর্ব- উন্মেষ পর্ব, মি'রাজ পর্ব ও ওফাৎ পর্ব।

লেখকের মতে আহাদ থেকে আহমদ অর্থাৎ মুহম্মদের (স) জন্ম। এ গ্রন্থে দেশি বাস্তবজীবনের নানা বিশ্বাস, সংস্কার, আচার-আচরণ, রীতি রেওয়াজ প্রতিফলিত হয়েছে। আবদুল্লাহর ও মুহম্মদের রূপ বর্ণনায় সব দেশি অলঙ্কারই ব্যবহৃত। 

খাদিজা মুহম্মদের বিবাহ প্রস্তাবে পারিবারিক দ্বিধা-দ্বন্দু, যৌতুক, ভোজ ও ভোজ্য সামগ্রী প্রভৃতির বর্ণনায় আমাদের ঘরোয়া ও বাস্তবজীবনের চিত্র মেলে। বরের যৌতুক হিসেবে সোনা, রূপা, রত্ন, পশু, দাসদাসী প্রভৃতি। উমরকে রসুল হত্যায় প্ররোচিত করার জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।

রসুলের স্ত্রীদের নাম ও তাদের পরিচয়, পুত্র-কন্যাদের নাম এ গ্রন্থে রয়েছে। মুহম্মদের নবুয়ত অবিশ্বাসীদের কাছে টোনা বলে নিন্দিত ছিল। রসুলের পদরেণুর স্পর্শে অন্ধের দৃষ্টিলাভ, মৃগীর বাকশক্তি, চন্দ্র দ্বিখণ্ডীকরণ, হিযরতকালীন ঘটনা প্রভৃতি রসুলী মোজেযার

প্রমাণ ।

মিরাজকালে রসুল প্রথম আকাশে আদমকে, দ্বিতীয় আকাশে সময় ঘোষক কুক্কুটকে তৃতীয় আসমানে মুসাকে, চতুর্থ আসমানে আজরাইলকে, ষষ্ঠ গগনে নরক রক্ষক এবং সপ্তম গগনে বায়তুল মুকাদ্দেস, মিকাইল, সিদ্রাতুল-মনতাহা বৃক্ষ, নবগ্রহ প্রভৃতি দেখেন। ওফাৎ-ই-রসুল এর বিবরণেই নবীবংশ শেষ করা হয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ