নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো অপেক্ষা অপ্রধান চরিত্রগুলো বেশি সক্রিয় আলোচনা কর

নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো অপেক্ষা অপ্রধান চরিত্রগুলো বেশি সক্রিয়। আলোচনা কর ।
নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো অপেক্ষা অপ্রধান চরিত্রগুলো বেশি সক্রিয়। আলোচনা কর ।
নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো অপেক্ষা অপ্রধান চরিত্রগুলো বেশি সক্রিয়। আলোচনা কর ।

উত্তর:বাংলা নাটকের অগ্রপথিক মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক 'কৃষ্ণকুমারী'। কৃষ্ণকুমারী নাটকের নামকরণ হয়েছে রাজকন্যা কৃষ্ণকুমারীর নামে। এ নাটকে কৃষ্ণকে ঘিরে কাহিনী আবর্তিত, তাছাড়া কৃষ্ণার বাবা রাজা ভীমসিংহও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ নাটকের অপ্রধান চরিত্র যেমন- মদনিকা, ধনদাস এরাই নাটকে অধিকতর সক্রিয়। এদের সক্রিয়তায় কাহিনী আবর্তিত বিবর্তিত হতে হতে পরিণতি পেয়েছে।

উদয়পুরের শৈলরাজ ভীমসিংহের একমাত্র কন্যা সুন্দরী কুমারী কৃষ্ণা। এর নামেই নাটকের নামকরণ করা হয়েছে। নাটকটির ট্র্যাজিক ত্বরান্বিত করেছে কৃষ্ণকুমারীর কিংবদন্তিতুল্য সৌন্দর্য। জগৎসিংহের ভাষায়- *কোন ঋষিবরের অভিশাপে এ জলধিতলে এসে বাস করিতেছে।” মদনিকার মতে, “কৃষ্ণার মতো এমন রূপ-লাবণ্য পৃথিবীতে আর কোথাও নাই।” তার সৌন্দর্যকে ঘিরে উদয়পুরে নেমে এসেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং কৃষ্ণা নিক্ষিপ্ত হয়েছে বেদনাময় মৃত্যুর দিকে। কৃষ্ণকুমারী এ নাটকের প্রাণ। সে মার্জিত ও বিনম্রনবদূত অনাস বাংলা দ্বিতীয় বর্ষ

সৌন্দর্যের অধিকারিণী। তপস্বিনীর মতে সে সাক্ষাৎ উমা মধুসূদনের ভাষায়— Dignified yet gentle. তার চরিত্রের প্রধান গুণ সরলতা। মদনিকার মুখে মানসিংহের স্তুতি শুনে সরলা কৃষ্ণা মানসিংহে অনুরক্তা হয়ে ওঠে। পিতামাতার স্নেহাধিক্যের ছায়ায় তার চরিত্রে কোমল স্পর্শকাতর ভাব সঞ্চারিত করেছেন মধুসূদন। এ কোমলতা, স্পর্শকাতরতা এবং কৈশোর সরলতা শেষ পর্যন্ত তার চরিত্রে অক্ষত থাকে নি। সংগীতচর্চা এবং ফুলবনে জলসেচের নিশ্চিত রাজা হতে, পিতামাতার স্নেহ আবরণ থেকে মধুসূদন অবশেষে তাকে নিয়ে এসেছেন রাজনৈতিক ঘটনা সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে।

কিশোরী হৃদয়ে প্রথম প্রেমের সব বিস্ময়, সব ব্যাকুলতা, সব ধরনের অবুঝ অসতর্কতা এর মধ্যে ছিল। এ নব প্রেম তাকে নিশ্চিত পুষ্পবিন্যাস এবং সংগীতরসের রাজ্য থেকে নির্বাসিত করল। প্রেম তাকে নিক্ষেপ করল মধুর যন্ত্রণার জগতে। এ স্বপ্ন দর্শন কৃষ্ণকুমারীকে এক ভাবময় জগতের সন্ধান দিলেও রাজনৈতিক দোলাচলে তার ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। কৃষ্ণার দুই পাণিপ্রার্থীর সংঘর্ষ হতে রাজ্যকে নিরাপদ করতে কৃষ্ণা আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

উদয়পুরের রানা ভীমসিংহ কৃষ্ণকুমারী নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু চরিত্রটি দুর্বল এবং নিষ্ক্রিয়। তিনি কোথাও নিজ সঙ্কল্পের দৃঢ়তা প্রকাশ করেন নি। জগৎসিংহের হাতে মেয়ে কৃষ্ণাকে বিয়ে দেবার ইচ্ছে থাকলেও মহারাষ্ট্রপতির নির্দেশে জয়পুরের তথা জগৎসিংহের দূতকে ফিরিয়ে দিয়েছে। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পত্র অনুযায়ী কৃষ্ণাকে হত্যা করার নির্দেশ ছোটভাই বলেন্দ্র সিংহকে দিয়েছে। 

তার চরিত্রে বলিষ্ঠতা নেই। প্রতিকূল অবস্থার উপর প্রাধান্য বিস্তার করার কোনো উদ্যোগ তার চরিত্রে নেই। তিনি শুধু নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে অন্যকে দুঃখ দিয়েছেন, নিজে দুঃখ পেয়েছেন। তিনি মুখে বলেছেন— “ব্যাধের ভয়ে শৃগাল গহ্বরে প্রবেশ করে, কিন্তু সিংহের কি সে রীতি?” কিন্তু ক্ষত্রিয় বীরের মতো আচরণ করে নি।

ভীমসিংহের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রাবল্য দেখা যায় নি। কৃষ্ণা জীবিত থাকতে যে বিবাদ মিটতে পারে না, বিবাদ না মিটলে দেশের কুলমর্যাদার সর্বনাশ হবে— এসব তিনি বলেছেন, কিন্তু তিনি সংকল্প স্থির করে কাজ করতে পারেন নি।

কর্তব্য ও স্নেহের বিপরীতমুখী আকর্ষণে তার হৃদয়ে প্রচণ্ড ঝটিকাবর্ত তৈরি হয় নি। ভীমসিংহ বহুবার অতীত গৌরবের কথা উল্লেখ করেছেন ও নিজের অসহায় অবস্থাকে ধিক্কার দিয়েছেন কিন্তু সংকট সমস্যায় বীরের মতো দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেন নি। তবে অপত্যস্নেহ তার হৃদয়ে যে আলোড়ন তুলেছে তাতে তার মানবিক মহিমা প্রকাশিত হয়েছে। 

দেশ-জাতির প্রত্যাসন্ন দুর্যোগের মুখে রাণার পৌরুষদীপ্ত প্রতিরোধস্পৃহা প্রকট হলে তিনি ট্র্যাজেডির নায়ক হতে পারতেন। তার চরিত্র কারুণা সৃষ্টি করলেও ট্র্যাজেডির মহিমা হতে বঞ্চিত হয়েছে।

'কৃষ্ণকুমারী' নাটকের বিয়োগান্ত পরিণতির জন্য যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকে তবে সে মদনিকা। সে জয়পুররাজ জগৎসিংহের বারবিলাসিনী বিলাসবতীর সহচরী। সে চতুরা ও বুদ্ধিমতী। মদনিকা মধুসূদনের প্রিয় চরিত্র। তাঁর এক পত্রে জানা যায়, ধনদাস ধূর্ত কিন্তু মদনিকা তার অপেক্ষা অনেক বেশি ধূর্ত। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, দুঃসাহসিকতা তার চরিত্রের অভিজ্ঞান। ধনদাস জগৎসিংহের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উদয়পুরে কৃষ্ণার বাবার কাছে গেছে।

 বিলাসবর্তী যেহেতু জগৎসিংহকে ভালোবাসে তাই সে ছদ্মবেশে উদয়পুরে যায় এবং কৃষ্ণার বিয়ে যাতে জগৎসিংহের সাথে না হয় সে ব্যবস্থা করে। মদনিকা কৃষ্ণার নামে মরুদেশীয় রাজা মানসিংহকে জগৎসিংহের হাত হতে উদ্ধারের জন্য পত্র লেখে এবং মানসিংহকে ভালোবাসার কথা জানায়। সেই সূত্রে সে মানসিংহের দূতী হয়ে কৃষ্ণার কাছে গিয়ে মানসিংহের স্তুতি করে এবং চিত্রপট দেখিয়ে মানসিংহের ওপর কৃষ্ণাকে অনুরক্তা করে তোলে। ধনদাস ও মরুদেশীয় দূতের মধ্যে বিবাদ বাঁধিয়েছে। তার চরিত্রে আত্মচিন্তার উদ্রেক হতে দেখা যায়।

 সে বলেছে- এ যেন দাবানলের রূপ ধরে এ সুলোচনা কুরঙ্গিনীকে দগ্ধ না করে।” সে বারাঙ্গনার সহচরী, বনের পাখির মতো স্বেচ্ছার অধীন। কৃষ্ণার সান্নিধ্যে এসে তাকে যথার্থ ভালোবেসেছে। কৃষ্ণা চরিত্রের লজ্জা ও সুশীলতায় সে মুগ্ধ এবং তারই আলোকে নিজের অন্ধকার দিকটি দেখতে পেয়েছে। যারা স্ত্রীলোককেবাবদ্যালয়ের প্রশ্ন ও উত্তর


অবোধ বলে ঘৃণা করে, তাদের মদনিকা চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, স্ত্রীলোকের জন্ম শক্তিকুলে। উদার মানবিকতায়, হাস্যরসে, প্রাণচাঞ্চল্যে, বুদ্ধিবৃত্তির সাথে হৃদয়ানুভূতির সমন্বয়ে তার চরিত্রটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

ধনদাস-এর স্বভাব ইয়াগোর মতোই ক্রুর অনিষ্টান্বেষী এবং দুর্নীতিপরায়ণ। ধনদাসের চরিত্রে একটি বৃত্তি প্রবল তা হলো তার অর্থলোলুপতা। সে রাজা জগৎসিংহের সহচর। অর্থের জন্য সে করতে পারে না এমন কিছু নেই। অর্থলোলুপতার অনুষঙ্গে তার চরিত্রে নারীলোলুপতার সৃষ্টি হয়েছে। সে রাজার নারী সংগ্রাহক। দরিদ্র বিলাসবর্তীকে অর্থের জন্য সে বারবনিতা করেছে। তার চরিত্রের বৃত্তিগুলোকে সে চাতুর্যের সাথে সম্পন্ন করতে চেয়েছে। নিজের বুদ্ধিতে তার প্রচণ্ড আস্থা। নারীর বুদ্ধিকে সে অবজ্ঞা করে। অর্থের কারণে বহু নারীর ধর্ম নষ্ট করেছে।

অর্থ সংগ্রহের কারণে সে প্রায় বিনামূল্যে এক সুন্দরী নারীর চিত্রপট সংগ্রহ করে জগৎসিংহকে দেখায়। চিত্রটিকে সে বিশ হাজার মুদ্রায় বিক্রি করে এবং রাজাকে কৃষ্ণার পাণিপ্রার্থনায় অনুপ্রাণিত করে। দৌত্যকার্যে নিয়োজিত হতে গিয়ে সে রাজার কাছ থেকে মূল্যবান আংটি হাতিয়ে নেয়। 

সে অর্থের জন্য যেকোনো লোকের মিথ্যা গুণগান করে, আবার দোষারোপও করে। সে মনে করে যাকে বিধাতা বুদ্ধি দেন, তাকে সকলই দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মদনিকা তা ভুল বলে প্রমাণিত করেছে। তার পাপকর্মের প্রতিফল সে পেয়েছে। অনুশোচনার মাধ্যমেই ধনদাস চরিত্রটি নতুন মাত্রা পেয়েছে।

বিলাসবর্তী নায়িকা কৃষ্ণকুমারীর বিপরীত কোটিতে স্থাপিত। সে দরিদ্র নারীর হতভাগ্য কন্যা। ধনদাস তাকে নিয়ে এসে আশ্রয় দেবার নামে জগৎসিংহের বারবনিতা করে তুলেছে। কৃষ্ণার চেয়ে বিলাসবর্তী আমাদের বেশি আকর্ষণ করে। কেননা, সে কৃষ্ণার চেয়ে বিশেষ সক্রিয়। বিলাসবর্তী দেহবিলাসিনী। পুষ্পের ন্যায় মধুলোভী ভ্রমরকে আকর্ষণ করে। মুগ্ধ করাই তার ধর্ম, মুগ্ধ হওয়া নয়। কিন্তু সে বিধিবদ্ধ আইনে বন্দী নয়। 

তাই বিলাসবর্তী জগৎসিংহকে প্রণয়পাশে বাঁধতে গিয়ে নিজেই বাঁধা পড়েছে তার কাছে। সে পোড়াতে গিয়ে নিজেই পুড়ে মরেছে। তার আহাজারিতে মদনিকা জগৎসিংহের সাথে কৃষ্ণার বিয়েতে বাধা সৃষ্টি করেছে। সে খাঁটি প্রেমিকা, অভিনয় জানে না। অর্থ অপেক্ষা প্রেমেই তার ঝোঁক। সে মানবতার প্রতীক, ফলে তার জীবন নিয়ে যে ধনদাস ছিনিমিনি খেলেছে তাকেই সে রাজার হাত হতে বাঁচিয়েছে। বিলাসবর্তী চরিত্র নাট্যকারের সহানুভূতির ফসল।

বলেন্দ্রসিংহ অপ্রধান চরিত্র হলেও ভীমসিংহ বা কৃষ্ণকুমারীর চেয়ে জীবন্ত বলেই আমাদের সমর্থন কাড়ে। বলেন্দ্রসিংহ উদয়পুরের রাজা ভীমসিংহের ভাই ও সেনাপতি। অগ্রজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, তার আদেশ শিরোধার্য করে কর্তব্য পালনের প্রয়াস এবং স্নেহের সঙ্গে কর্তব্যনিষ্ঠার সম্মতির ফলে হৃদয়ের গভীর আলোড়ন তার মানবিক দিকটি সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছে। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পত্র পেয়ে মন্ত্রী দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে তাকে কর্তব্য পালনের কথা বিবেচনা করতে বললে সে উত্তর দিয়েছে-

“আমি বিলক্ষণ বিবেচনা করেছি। মহাশয়, একি মানুষের কর্ম?”

আবার পঞ্চমাঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে সে মন্ত্রীকে বলেছে- “এ ঘৃণাস্পদ কর্ম করতে আমাকে আর অনুরোধ করো না।”

কিন্তু শেষে অগ্রজের আদেশে রাজকুল মৃণাল থেকে প্রফুল্ল কনকপদ্ম ছিন্ন করার জন্য কৃষ্ণার শয়ন মন্দিরে প্রবেশ করে কৃষ্ণার দিকে গভীর দরদে শেষবারের মতো চেয়ে থাকে, তার অসি কাঁপতে থাকে। কৃষ্ণার ঘুম ভেঙে গেলে সে যে প্রশ্ন করেছে তা শুনে বলেন্দ্র রোদন করতে থাকে। কৃষ্ণার আত্মবিসর্জন, রাজার উন্মত্ততা, মহিষী অহল্যা বাঈ-এর মৃত্যু “মৃত্যু কি আমাকে ভুলে বলেন্দ্রসিংহের অন্তরের নিগূঢ়তম প্রদেশে সন্তাপ সৃষ্টি করে— আছে?”- আলোড়িত এই উক্তি তার চরিত্রের মানবিক রূপকে উদ্ঘাটিত করেছে। 

স্নেহ, প্রেম, কর্তব্যে, অনুশোচনায় বলেন্দ্রসিংহ 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকের এক অনবদ্য জীবন্ত চরিত্র। 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকে দু'জন মন্ত্রী চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। রাজা ভীমসিংহের মন্ত্রী সত্যদাস এবং জগৎসিংহের মন্ত্রী নারায়ণ মিশ্র। মন্ত্রীদ্বয়ের চরিত্র মূলত মন্ত্রী শ্রেণী চরিত্রেরই দ্যোতক। তবে রাজা ভীমসিংহের চরিত্রের মধ্যে কিছুটা ব্যক্তিরূপের পরিচয় মেলে।

জগৎসিংহের মন্ত্রী রাজকার্যে সদা আন্তরিক। কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ হতে জগৎসিংহ উপেক্ষিত হলে রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করতে চেয়েছে। কিন্তু নারায়ণ মিশ্র রাজাকে যুদ্ধ হতে নিরস্ত হতে বলেছে। তার মতে তুচ্ছ তুচ্ছ অগ্নিকণা থেকে যে ঘোরতর দাবানল সৃষ্টি হয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি আক্ষেপ করে বলেছে- "বিধাতার নিবন্ধকে খণ্ডন করতে পারে কে?” তবে নারায়ণ মিশ্রকে করবে সেকথা চিন্তা করে মন্ত্রী শঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু রাজা তার পরামর্শ গ্রহণ করে নি। মিষ্টি তেমন কোনো গুরুতর পর্যায়ের সম্মুখীন হতে হয় নি।

ভীমসিংহের মন্ত্রী সত্যদাস দীর্ঘদিন ধরে শৈলরাজের সুখে-দুঃখে রাজার সাথে আছে। সত্যদাসকে ভীমসিংহের কুলমর্যাদা ও উদয়পুরের সমূহ বিপদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। মন্ত্রী কৃষ্ণার হত্যা বিষয়ে বলেছে যে, রাজ্য রক্ষার্থে তার মৃত্যুই অনস্বীকার্য। 

রাজকুমারীর মৃত্যু ভিন্ন পরিত্রাণ লাভের কোনো উপায় নেই। তাকে এ ক্ষেত্রে অমানবিক বোধ হতে পারে, কিন্তু মনে রাখা দরকার মন্ত্রীর কাজ হচ্ছে রাজ্য ও রাজ্যের জনগণকে রক্ষা, ব্যক্তি কৃষ্ণাকে নয়। রাজাকে সে প্রবোধ দিয়েছে- “মহারাজ, এ সকল বিধাতার ইচ্ছে তো নয়।”

রাজার উন্মত্ত অবস্থা, কৃষ্ণার আত্মহনন ও মহিষীর মৃত্যু মন্ত্রীকেও বিচলিত করেছে। মন্ত্রী বলেন্দ্রসিংহকে বলেছে- “আমি চিরকাল এই বংশের অধীন, আমাকে কি শেষে এই দেখতে হলো।” তবু শোক সংবরণ করে কর্তব্য পালন বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে এবং রাজভ্রাতাকে কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করতে প্রয়াস পেয়েছে।

শেক্সপীয়র যেরূপ মানবজীবন সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলেন, মধুসূদনও তদ্রূপ জীবন রহস্যের পরিচয় জানার জন্য আগ্রহী ছিলেন। ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণ তাঁর মনে মানবজীবনের রূপরহস্য সম্পর্কে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। ঐতিহাসিক চরিত্র সৃষ্টিতে তার স্বাধীনতা ছিল সীমাবদ্ধ কিন্তু অনৈতিহাসিক চরিত্রসমূহে তিনি তাঁর শিল্পী মনের উৎকণ্ঠা প্রশমিত করেছিলেন। এর ফলে 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকে আমরা নানা ধরনের বাস্তব জীবনাশ্রয়ী চরিত্রের পরিচয় পাই।

‘কৃষ্ণকুমারী' নাটকে অপ্রধান চরিত্রগুলো মোটেই অকিঞ্চিতকর বা নগণ্য নয়। এ চরিত্রগুলো নির্মাণে শিল্পী অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকে কৃষ্ণকুমারী ও ভীমসিংহ প্রধান হলেও তার পাশাপাশি অন্য যে চরিত্রগুলো আমরা লক্ষ করি, যাদের অপ্রধান চরিত্র বলে ধরা হয়, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও নাটকে তাদের পালনীয় ভূমিকার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে- চরিত্রগুলো গুরুত্বহীন নয়; বরং কৃষ্ণার চরিত্র বিকাশে ও কাহিনীর গ্রন্থন এবং পরিণতি নির্মাণে এরা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। 

নাটকে কৃষ্ণার আত্মবিসর্জনের মানসিকতা সৃষ্টির পেছনে পূর্ব নির্ধারিত নিয়তির কোনো চক্রান্ত ছিল না। পারিপার্শ্বিকতা, অপ্রধান চরিত্র এবং ঘটনার প্রেক্ষিতে কৃষ্ণা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। কৃষ্ণকুমারীর মৃত্যু তার নিজের কোন ভ্রান্তির দ্বারা ঘটে নি। বা তার কোনো কার্যের দ্বারাও পরিণতি অনিবার্য হয়ে ওঠে নি। মদনিকা, ধনদাস, সত্যদাস প্রভৃতি অপ্রধান চরিত্রসমূহের কার্যকলাপই কৃষ্ণকুমারীকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ