মৈমনসিংহ গীতিকার বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্দেশ করো
মৈমনসিংহ গীতিকার বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্দেশ করো ।
![]() |
মৈমনসিংহ গীতিকার বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্দেশ করো । |
উত্তর:সংগীতাকারে বর্ণিত কাহিনিকে গীতিকা বলে। গীতিকার মধ্যে মৈমনসিংহ গীতিকাই শ্রেষ্ঠ। এর কাহিনিগুলো প্রেমমূলক, নারী চরিত্রই এতে প্রাধান্য পেয়েছে। নারীর ব্যক্তিত্ব, আত্মবোধ, স্বাতন্ত্র্য, সতীত্ব, বিশেষত ত্যাগের মহিমাই উজ্জ্বল।মৈমনসিংহ গীতিকার বিষয়গুলো একমুখীন— বৈচিত্রহীন। নারীর মধ্যে প্রেমের শক্তি এখানে দুর্জয় গীতিকাটির আখ্যান পরিকল্পনায় ও চরিত্রসৃষ্টিতে শৈথিল্য রয়েছে।
এ গীতিকায় ব্যক্তি অনুভূতির প্রাধান্য পেয়েছে। গীতিকাটির কাহিনি বিস্মৃত ও শাখা-প্রশাখা বিদ্যমান। এখানে বন্দনা অংশ আছে। নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হয়েছে। বিরতিহীন অবিভক্ত বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এ গীতিকাটির কাহিনি প্রেম, মিলন ও বিরহকেন্দ্রিক। ব্যর্থপ্রেমই এ গীতিকার বিশেষ দিক। গীতিকাটি সংগীতে লেখা কাহিনি।
মৈমনসিংহ গীতিকা গীত ও অভিনয়যোগ্য। এই গীতিকার কবিগণ সরল বাংলা কথায় উদ্দীপনার ছন্দে গীত গেয়ে গেছেন। মৈমনসিংহ গীতিকায় আমরা বাঙালা ভাষার স্বরূপটি পাই। বহু শতাব্দীকাল পাশাপাশি বাস করবার ফলে এই গীতসাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়ের— এখানে পণ্ডিতগণের রক্তচক্ষু উপেক্ষিত। লেখকদের মধ্যে হিন্দু যতজন মুসলমানও ততজন ।
আবার এই গীতিকায় হিন্দু নায়ক মুসলমান নায়িকা এবং মুসলমান নায়ক হিন্দু নায়িকা। কবিরা প্রকৃত ঘটনাই লিপিবদ্ধ করেছেন। এসব পালাগানের শ্রোতা হিন্দু-মুসলমান সবাই। এ গীতিকাগুলোতে জাতীয় বিদ্বেষের কণিকামাত্র নেই, সত্য ঘটনা স্বকীয় গৌরবের বেদির উপর দাঁড়িয়ে শ্রোতার অনুরাগ আকর্ষণ করেছে। এ গীতিকার দেওয়ানের অত্যাচার মুসলমান হয়ে হিন্দুর উপর নয়— বরং দুর্বলের উপর প্রবলের। ব্যভিচারীর ব্যভিচার- যা হিন্দু বা মুসলমানের সম্প্রদায়ঘটিত নয় ।
মৈমনসিংহ গীতিকায় শাস্ত্রের অনুশাসনে বাঙালির ঘরগুলোকে এতটা আঁটাআঁটি করে বাঁধেনি। এখানে পাষাণচাপা অত্যাচারের ফলে প্রেমে বিদ্রোহবাদের সৃষ্টি হয়নি। এখানেঘরের জিনিসকে শিকল দিয়ে ঘরে বেঁধে রাখার চেষ্টা নেই, এবং রমণীদের জন্য পিঁজরা তৈরি হয়নি।প্রেম জিনিসটা কষ্টকে বরণ করে আবির্ভূত হয়ে থাকে, কিন্তু নিজের আনন্দে প্রেমের পরম তৃপ্তি, শক্তি প্রয়োগে প্রেম পাওয়া যায় না। মৈমনসিংহ গীতিকা আমাদেরকে কিছু গীতিকথা উপহার দিয়েছে।
এর অধিকাংশ কাহিনি ঐতিহাসিক ঘটনামূলক। এই গীতিকাগুলোর নারী চরিত্রসমূহ প্রেমে দুর্জয় আত্মমর্যাদায় অলঙ্ঘ্য পবিত্রতা ও অত্যাচারীর হীন পরাজয় জীবন্তভাবে দেখিয়ে থাকে। নারী প্রকৃতি মন্ত্র মুখস্থ করে বড়ো হয়নি— চিরকাল বড়ো হয়েছে। জনতারূপে তিনি জগতের বরেণ্যা, স্ত্রীরূপে তিনি জগতের প্রাণ। প্রকৃতি যেখানে সেই প্রাণ দান করেছে সেখানেই সে প্রাণ অপূর্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৈমনসিংহ গীতিকায় সর্বত্র দেখা যায়— পুরুষ ও নারী নিজেরা বিয়ের পূর্বে পরস্পরকে আত্মদান করেছে, তারপর বিয়ে হয়েছে।
মৈমনসিংহ গীতিকার নায়ক-নায়িকার কারও বাল্যকালে পরিণয় হয়নি। মৈমনসিংহ গীতিকায় যে সকল কথা খুব স্পষ্ট লেখা— বঙ্গদেশের অন্যত্র ও সামাজিক আদর্শ কতকটা সেরূপই ছিল।
মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনি নাট্যকারিমায়, কৌতূহল উদ্দীপ্ততায়, নায়ক-নায়িকার অপূর্ব ত্যাগে মহিমামণ্ডিত। এ গীতিকার নায়ক-নায়িকা মুক্ত গগনের, সীমাবিহীন পথের পথিক। এ গীতিকার মেয়েরা সতীত্ব বলতে বোঝে যে- তার প্রেমিক প্রবর ভিন্ন অন্য কারও সাথে বিয়ে হলে তারা নিজেকে অসতী জ্ঞান করে, তাই তারা আত্মহনন করে হলেও মৃত্যুর পর প্রেমিক প্রবরের সাথে মিলিত হয়- কিন্তু প্রেমিক ভিন্ন পুরুষকে বিয়ে করে না।
মৈমনসিংহ অঞ্চলের যে সকল ঘটনা অশ্রুসিক্ত হয়ে লোকেরা শুনেছে, যে সকল অবাধ ও অপ্রতিহত অত্যাচার যমের দুর্জয় চক্রের ন্যায় সরল-নিরীহ প্রাণকে পিষে চলে গেছে- সেই সকল অপরূপ করুণ কথা গ্রাম্য কবিরা পয়ারে গেথে রেখেছেন।
তারা ছন্দে শব্দেশ্বর্যের কাঙাল হতে পারেন, গীতিকাগুলোতে বড়ো বড়ো তাল মান হয়তো নেই। কিন্তু মৈমনসিংহ গীতিকা যারা লিখেছেন, তাঁদের অশ্রু হয়তো ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এ সকল কাহিনির শ্রোতাদের অশ্রু কখনো ফুরাবে না- এখানেই মৈমনসিংহ গীতিকার বিশেষত্ব