মধ্যযুগের মর্সিয়া সাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
মধ্যযুগের মর্সিয়া সাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
![]() |
মধ্যযুগের মর্সিয়া সাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। |
উত্তর: মর্সিয়া শব্দের অর্থ শোক বা আহাজারি। মর্সিয়া কাব্য বা সাহিত্য মূলত শোককাব্য। শোকের উৎস যুদ্ধক্ষেত্র। কারবালা যুদ্ধের কাব্যই ষোল-সতের শতক থেকে বাংলার মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় হতে থাকে। কারণ, কারবালার যুদ্ধ হোসেনের সাথে এজিদের।
আলীর পুত্র হাসান-হোসেনের অনুসারীরা শিয়া হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে দাক্ষিণাত্যের শিয়াদের ও ইরানী শিয়াদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, সে সূত্রেই ষোল শতক থেকেই শিয়াদের শোকের কাহিনী বাংলায় গুরুত্ব পায় ।
মর্সিয়া বা শোককাব্যের লেখক মধ্যযুগের মুসলমান কবিরা। মুসলমান মাত্রেই হযরত মুহম্মদ (স) এর সঙ্গে জড়িত। তাঁরই দৌহিত্র হাসান-হোসেনের প্রতি আমাদের সহানুভূতি স্বাভাবিক। সে কারণেই মুসলিম কবিরা বিশেষ আন্তকিতার সাথে মর্সিয়া কাব্য লিখেছেন এবং মর্সিয়া কাব্য তথা কারবালার বেদনাসিক্ত কাহিনী আমাদের কাছে আদরণীয় হয়েছে।
হযরত আলী (রা) এর মৃত্যুর পর এজিদ নিজেকে কুফার অধিপতি বলে ঘোষণা দেয়। তারই চক্রান্তে হযরত হাসান (রা) বিষ প্রয়োগে মৃত্যুবরণ করেন। হোসেন কুফা ত্যাগ করেন। অতঃপর কুফাবাসীদের আহবানে তিনি কুফায় ফিরে আসতে গেলে এজিদের সৈন্যবাহিনীর সাথে কারবালায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এজিদের সেনাপতি মারওয়ান ফোরাত নদীর পাড় দখল করে রাখে। ফলে হোসেনের সৈন্যরা পানির অভাবে ক্রমশ দুর্বল ও ক্ষীণজীবী হয়ে ওঠে। হোসেন (রা) অচৈতন্য অবস্থায় কারবালায় পড়ে থাকলে অর্থলোলুপ সীমার হেসেনের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে তাকে হত্যা করে।
কারবালার এ বেদনার কাহিনীই মর্সিয়া সাহিত্যের মৌল উপজীব্য। হযরত আলী (রা) এর পুত্র হযরত মুহম্মদ (স) এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত হোসেনের যে শোচনীয় ও বেদনার্ত পরাজয়, যা আমাদেরকে শোক সাগরে ভাসায়। এ সাহিত্যে নায়ক বিজয় গৌরবহীন এবং পরাজিত।
পাশবিকভাবে নায়কের বেদনাদীর্ণ মৃত্যুতে এ সাহিত্যের রস হয়ে ওঠে করুণ। শোকের বা কান্নার আকর বলেই এ বিলাপপ্রধান সাহিত্যের নাম মর্সিয়া বা শোককাব্য । কারবালার এ কাহিনীকে নানাভাবে বিভিন্ন কবি পরঙ্গমতার নন্দনীয় করে তুলেছেন।
এ কাব্য বেদনার বলেই আমাদের কাছে নন্দনীয় নয়। এ কাব্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় মানুষের কিছু সহজাত প্রবৃত্তি। সেগুলো হচ্ছে— অন্যায়ের প্রতিবাদে জীবনপণ; জীবনের চেয়ে ইজ্জত বড়, জানের চেয়ে মান বড়, তার চেয়ে বড় স্বাধীনতা।
রাজতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসন নয় বরং গণতন্ত্রই মানষের কাম্য। হোসেন (রা) এজিদের অনুগত থাকলে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেন নি। জীবনের বিনিময়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় মানুষ যুগে যুগে ন্যায়ের পক্ষেই বেদনার্ত হয়ে উঠে।
কারবালার ঘটনা নিয়ে মধ্যযুগে যেসব মুসলমান কবিরা শোক কাব্য রচনা করেছেন তারা হচ্ছেন—
কবির নাম কাব্যের নাম
১.দৌলত উজির বাহরাম খান ইমাম বিজয়
২.শেখ ফয়জুল্লাহ যয়নবের চৌতিশা
৩. মুহম্মদ খান মক্তুল হোসেন কাব্য
8.হায়াৎ মাহমুদ কারবালা কাব্য
৫.আব্দুল আলিম হানিফার লড়াই
৬.নজর আলী হানিফার কারবালা যাত্রা
૧.আমান উল্লাহ মোহাম্মদ হানিফার লড়াই
৮.নসরুল্লাহ খন্দকার কারবালা কাহিনী
মর্সিয়া কাব্যে কারবালার মর্মস্তুদ কাহিনীর সাথে সাথে হাসানপুর কাশেমের সাথে, হোসেনের কন্যা সখিনার প্রণয় উপাখ্যানও বর্ণিত হয়েছে।
'কারবালা' শব্দটি উচ্চারিত হলেই মুসলমানের সামনে এক বেদনার্ত শোকগাথার চিত্র ভেসে উঠে, যা নিয়ে মধ্যযুগের মর্সিয়া সাহিত্য রচিত। আজও তা নানাভাবে আমাদেরকে আন্দোলিত করে, করে শোকার্ত।