ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থ অবলম্বনে কবির কবিমানসের পরিচয় দাও
ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থ অবলম্বনে কবির কবিমানসের পরিচয় দাও ।
![]() |
ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থ অবলম্বনে কবির কবিমানসের পরিচয় দাও । |
উত্তর:রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। শেষ নিঃশ্বাসেও কবি। রবীন্দ্রকাব্যে বারবার তাঁর ভাবনার পালাবদল ঘটেছে। ‘ক্ষণিকা' (১৩০৭) কাব্যে এসে কবি তাঁর আগের জীবনের নিকট হতে অর্থাৎ মানব ও প্রকৃতির সৌন্দর্য মাধুর্য প্রেমে উপভোগের জীবন হতে, শিল্পীর নিরবচ্ছিন্ন সৌন্দর্যরস পানের জীবন হতে বিদায় নিয়ে মহাজীবনের পথে, আত্মোপলব্ধির পথে, নিগূঢ় অধ্যাত্ম জীবনের পথে যাত্রা করলেন।
কিন্তু পেছন ফেলে যিনি যাত্রা করলেন তাঁর বড় পরিচয় তিনি কবি। কবি মানেই রসভোক্তা। এতদিন যে কবি-প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে থেকে রস উপভোগ করেছেন, তাদের গান তিনি উচ্চকণ্ঠে গেয়েছেন, কিন্তু আজ কবি ভিন্ন রসের সন্ধানে নতুন পথের পথিক। তাঁর উপভোগ্য রসের উৎস মানব ও প্রকৃতির সৌন্দর্য— আজ কবি সেই সৌন্দর্যের উৎস খুঁজতে চলেছেন।
চির সৌন্দর্য ও মাধুর্যময় রস এতদিন কবি এই বিশ্বের মধ্য দিয়েই অর্থাৎ প্রকৃতি ও মানবের মধ্য দিয়ে পান করেছেন। এ রসের চরম উপভোগ তাঁর হয়ে গিয়েছে। তাই এখন সৌন্দর্য মাধুর্য প্রেমের চিরন্তন উৎসের নিকটে গিয়ে, সেই পরম সৌন্দর্যময় ও রসময়ের নতুন নতুন প্রত্যক্ষ সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে এক অভিনব রস পান করতে চান। এ রস পানও এক প্রকার ভোগ, যা কবি-প্রকৃতির
৭৯৪
বিশেষ অংশ (কবির কাজই রস ভোগ)। তবে এ ভোগের পথ এবং পাথেয় ভিন্ন । এ পথে প্রকৃতি ও মানবকে পেছনে ফেলে কবি স্রষ্টার সন্ধানে চলেন- পূর্ণ জীবনের অভিলক্ষে।
পথের পাথেয় ত্যাগ ও বৈরাগ্য।
। এ
কিন্তু একথা সত্য যে- কবির কাছে প্রকৃতি ও মানবের রসই সর্বাপেক্ষা উপাদেয় ও লোভনীয় । প্রকৃতি ও মানবের সাথে তাঁর চিরকালের সম্বন্ধ। তাই একে ছেড়ে নতুন পথে যাত্রা করতে চাইলেও একে অনায়াসে ছাড়া যায় না, ছাড়া গেলেও ছাড়তে দারুণ বেদনা বোধ হয়।
তাই বিগত জীবনের সময়কে ভুলে থাকতে, সম্বন্ধ ছিন্নের ব্যথাকে লঘু করতে কবি ‘ক্ষণিকা”য় নিতান্ত আবেগহীনভাবে, সহজ দৃষ্টিতে বিগত জীবনের রসের ভাণ্ডারের দিকে (অর্থাৎ মানব ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের দিকে) একবার চোখ মেলে দেখে নিচ্ছেন এবং কৌতুকের আবরণে ব্যথাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন, আবার কবি চোখের জলও মুছছেন ।
কোনো বিতর্ক, বিচার না করে, কোনো চিন্তায় উদ্বেলিত না হয়ে, কোনো সামাজিক নিয়ম বা চির প্রচলিত প্রথাকে না মেনে, কোনো সুখে দুঃখে উদ্বেলিত না হয়ে সহজ সরল ও সত্য দৃষ্টি দিয়ে কবি জগৎ ও জীবনকে ক্ষণকালের জন্য দেখে তা থেকে আনন্দ আহরণ করেছেন। আর সাথে সাথে পরম প্রিয় বস্তু ত্যাগের অন্তর্গঢ় ঘন ব্যথাকে চটুল পরিহাসের প্রলেপে ঢাকতে চেষ্টা করেছেন।
“বাহিরে যবে হাসির ছটা
ভিতরে থাকে আঁখিরি জল।” (লীলা উৎসর্গ)
এই আবেগহীন সত্য, সহজ দৃষ্টি এবং অর্থপূর্ণ কৌতুক হাস্যোজ্জ্বল, স্নিগ্ধদীপ্তা ‘ক্ষণিকা’ কাব্যকে অভিনবত্ব দান করেছে।
কবি সংসারের দুঃখ-বেদনা, আশা-নৈরাশ্য, ভাবনা-চিন্তার অতীত শুভ্র মুক্ত এক পরমানন্দ নবজীবন কামনা করেছেন। কবি এমন এক বর্তমানকে আহ্বান করেছেন যাতে অতীত বা ভবিষ্যতের চিন্তা- আশা থাকবে না, এবং বর্তমানের সুখ-দুঃখেরও কোনো উত্তেজনাকর অনুভূতি থাকবে না। কেবল অকারণ পুলকে ক্ষণিক বর্তমানকে ক্ষণিক দিনের উৎসব মেলায় ক্ষণিক আনন্দসংগীত গাইতে চাচ্ছেন, কেবল ক্ষণিকের জন্য প্রভাতের রৌদ্ররঞ্জিত শিশিরবিন্দুর মতো উজ্জ্বল জীবন আকাঙ্ক্ষা করেছেন।