কাব্যনাট্য হিসেবে 'বিসর্জন'-এর সার্থকতা বিচার কর
কাব্যনাট্য হিসেবে 'বিসর্জন'-এর সার্থকতা বিচার কর
![]() |
কাব্যনাট্য হিসেবে 'বিসর্জন'-এর সার্থকতা বিচার কর |
উত্তর :সমগ্র রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের মধ্যে 'বিসর্জন' আখ্যানবস্তুর সুনিপুণ বিন্যাস কৌশলে, ঘটনার দ্রুত প্রবাহে, নাটকীয় চমৎকারিত্বে, পাত্রপাত্রীর অন্তরস্থিত ভাব ও বাইরের কর্মের সম্মিলিত দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বেগবান রূপের প্রকাশে, মঞ্চাভিনয়ের উপযোগিতায় একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। নাটকটি বহুল পঠিত ও প্রশংসিত । রূপক সাংকেতিক গণ্ডির বাইরে যে সমস্ত নাটক আছে, তাদের মধ্যে সব দিক দিয়েই 'বিসর্জন' নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ। তদুপরি নাটকের যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকলে নাটক নাটক হয়ে ওঠে, যেমন- আরম্ভ, উৎকর্ষ, পরিণতি, অঙ্কে বিভাজন, মঞ্চ কুশীলব, সংলাপ,ঘটনার ঐক্য, স্থানের ঐক্য— সব মিলে 'বিসর্জন' নাটকই। তবে 'বিসর্জন' কাব্যনাটকও বটে ।
কাব্যনাট্যের আকার ও গঠন নাটকের হলেও এর অন্তর গীতিকাব্যের। পাত্রপাত্রীর সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি বিশিষ্ট কবিমনেরই বিচিত্র ভাবের উৎসারণ ঘটে। কাব্যনাট্যের সমস্ত প্রকাশটি কবির ভাব-কল্পনার বহু বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল হয়ে একটা সংহত একক মূর্তি ধারণ করে, বহু সুরের আলাপন মিলে একটা ঐকতান সৃষ্টি হয়। নাটকের কথাবস্তু একটি অন্তর্মুখী বিশ্লেষণাত্মক কবিমনের ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে ।
কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে কবির সংগীতের প্রতি একটা টান থাকে । কাল্পনিক আখ্যায়িকা অবলম্বন করে নাটকের আকারে মূলত কাব্য রচনা করেন। এক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর মনের বিভিন্নমুখী বিচিত্র ভাব অবলম্বন করে লিরিক উচ্ছ্বাসের প্লাবন চলে। কাব্যনাট্যে ঘটনার সমাবেশ, দ্রুত আবর্তন ও সমগ্র পরিণতির ওপর নাট্যকারের কোন লক্ষ্য থাকে না। কাহিনীটির কাঠামো নাট্যকারের মনে থাকে মাত্র, তারপর পাত্রপাত্রীর মুখ দিয়ে ভাবটিকে
প্রকাশ করেন ।
'বিসর্জন' নাটকের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে নাটকটির মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে- ধর্মের অর্থহীন অন্ধসংস্কার ও চিরাচরিত যুক্তিহীন প্রথার সাথে নিত্য সত্য মানবধর্ম বা হৃদয়ধর্মের। নাটকের শুরু হয়েছে নিঃসন্তান রানী গুণবতীর সন্তান কামনার দ্বারা, একটি ক্ষুদ্র প্রাণকে বুকে চেপে ধরবার আকাঙ্ক্ষায়। এই আরম্ভের মধ্যে নাটকের মূল দ্বন্দ্বের এক পক্ষের যৌক্তিকতার অসারত্ব কৌশলে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। রানী একটি প্রাণের জন্য শত প্রাণ বিনষ্ট করতে চায়। প্রাণের প্রতি স্নেহ-প্রেম মানবের হৃদয়ধর্ম, কিন্তু অন্ধ সংস্কারবোধ তাকে রুদ্ধ করেছে।
অপর্ণার ছাগশিশু ধরে এনে বলি দেওয়ায় অপর্ণা রাজার কাছে নালিশ করেছে। অপর্ণার ছাগশিশু বলিই নাটকের বিরোধের বীজ। এ বীজ অঙ্কুরিত হল রাজার মনে এবং বলি নিষেধের মাধ্যমে তা পল্লবিত হল। এই ভাবের বীজ জয়সিংহের প্রশান্ত নিস্তরঙ্গ মনে তরঙ্গ তুলেছে। প্রথাধর্ম সত্য, না মানবধর্ম সত্য? রঘুপতি না অপর্ণা? এই দুই বিপরীতমুখী সত্যের সমন্বয় হল জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে।
অপর্ণার দ্বারা রোপিত বীজেরই পরিণামস্বরূপ রঘুপতির মধ্যে রাজার বিরুদ্ধে বিরোধ ঘনীভূত হয়ে ওঠে। যে ভাবসত্য রানী গুণবতীর অজ্ঞাতসারে তার মনের মধ্যে বিকশিত হয়, তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে অপর্ণার মধ্যে। সেই প্রাণের প্রতি ভালবাসাই নাটকের বিরোধের মূল হেতু ।
প্রাণের মূল্য কত গভীর একদল সে কথা বুঝেছে, অন্যদল বোঝে নি- বিরোধ সেখানেই উভয়পক্ষের বিরোধ উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে থাকে। রঘুপতি রাজার আদেশকে ধর্মে হস্তক্ষেপ জ্ঞান করে এবং ধর্মরক্ষার ভার ব্রাহ্মণের ওপর অর্পিত বলে মনে করে। রাজার আদেশে রানীর পূজার বলি মন্দির হতে ফিরে এলে ব্রাহ্মণের তেজ, গর্ব ও দম্ভের প্রতিমূর্তি রঘুপতির কাছে এক প্রচণ্ড আঘাত হিসেবে বাজে ।
শুরু হয় গোপন পথে রাজহত্যার ষড়যন্ত্র। রাজ্যের লোভ দেখিয়ে নক্ষত্র রায়কে দিয়ে ভ্রাতৃহত্যার চেষ্টা, গুরুতে বিশ্বাসী জয়সিংহকে দিয়ে রাজাকে হত্যার চেষ্টা। প্রতিমার পেছনে বসে 'রাজরক্ত চাই' বলে দেবীর নামে চালিয়ে দেয়। জয়সিংহ রাজহত্যায় উদ্যত হয়েও বিফল হল, তবে সে প্রতিজ্ঞা করে শ্রাবণের শেষ রাতে রাজরক্ত এনে দেবে। শেষ পর্যন্ত গুরুকে তুষ্ট করতে জয়সিংহ আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের প্রচণ্ড আঘাতে রঘুপতির সমস্ত বিরুদ্ধতা ধূলিসাৎ হয়। পাষাণ প্রতিমাকে ‘পিশাচী', 'মহারাক্ষুসী' বলে গালি দেয়, নদীতে নিক্ষেপ করে, মন্দির ছেড়ে অপর্ণার হাত ধরে চলে যায় ।
সন্তান প্রত্যাশী রানী গুণবর্তী স্বামীর মানবতাকে সন্তান প্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতা জ্ঞান করে স্বামীকে ছেড়ে রঘুপতির দলভুক্ত হয় । অতঃপর রানীও তার স্বামীর কাছে ফিরে আসে। ‘বিসর্জন' নাটক আগাগোড়াই নাটকীয় অবয়বে একটি নিটোল কবিতা। নাটকের বিষয় মাত্র একটি, তা হচ্ছে সন্তানের প্রতি, মায়ের প্রীতি ও স্নেহ তথা মাতৃত্ব । গুণবতীর মাতৃত্ব স্বাভাবিক ও সাধারণ, কিন্তু তার উপায়টি অমানবিক। একটি সন্তান দেবীর কাছে প্রার্থনা করে তার পা দুটি জীবনের রক্তে ধুয়ে দেওয়া— গুণবতীর মাতৃত্ব উল্টো স্রোতে প্রবাহিত। যার সূত্র ধরে প্রথাধর্ম ও মানবধর্মের সংঘাত এখানেই অপর্ণার মাতৃত্বের সাথে উচ্চকিত । আর কবিতার মত একটি বিষয়ই নাটকের উপজীব্য।কবির যেমন সুন্দরের দিকে দৃষ্টি, এখানে নাট্যকারের দৃষ্টিও শিবসুন্দর ও মানবতা। অপর্ণা এ নাটকে কবিতার মত এক বিমূর্ত চরিত্র, যে দ্বন্দ্বের মূল হোতা। তদুপরি জয়সিংহ যদিও দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় চরিত্র কিন্তু তার আত্মহননের সিদ্ধান্ত কবিরই মনোজগতের আড়ালে ছিল। ফলে নাটকের কথাবস্তু যেমন একটি অন্তর্মুখী বিশ্লেষণ, যা চৈতন্যের দ্বারা সূচিত, তেমনি জয়সিংহের সিদ্ধান্তও বিমূর্ত ।
'বিসর্জন' নাটকের সংলাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবিত্বময় উচ্ছ্বাস, কোন কোন স্থানে কথ্য ভাষার সাথে মিশ্রিত। মূল কথাবস্তুর সাথে ক্ষুদ্র আখ্যান অংশও নাটকে বিশেষভাবে জড়িত হয়েছে। আদর্শ মানবতার সাথে প্রথাধর্ম সংঘাতই নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়। তবে বাস্তবের একটা কঙ্কালকে পেছনে রেখে বাস্তব ও আদর্শের একটা সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে।
নাটকটির অধিকাংশ সংলাপ কবিতায়। তদুপরি নাটকে ক্ষেত্রবিশেষে বেশকিছু সংগীতের অবতারণা করা হয়েছে। যেমন- দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে অপর্ণার গীত, তৃতীয় দৃশ্যে জয়সিংহের কণ্ঠে গীত। সংগীতের মধ্য দিয়ে তাদের গভীর মানস প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। উপসংহারে বলা যায়, কবি রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটকীয় হয়েও ভাব প্রকাশের উৎকৃষ্ট বাহন হয়েছে। পাত্রপাত্রীর সুখ-দুঃখ, কামনা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের মনের নিগূঢ় পরিচয় লিরিক কাব্যের অন্তর্মুখী আবেগ অনবদ্য রূপদান করেছে। বিসর্জনের বহিরঙ্গ নাটকের অন্তরঙ্গ গীতি-কবিতার রসধারায় উজ্জ্বল। অব্যর্থ ও সুললিত শব্দ যোজনায়, কবিতায় নিপুণ অলংকার প্রয়োগে, ভাব-কল্পনার সাবলীল ও স্বতঃউৎসারিত প্রবাহে, ব্যঞ্জনাশক্তির চরম-উৎকর্ষে শ্রেষ্ঠ কাব্যনাট্য হিসেবে সফল ও সার্থক।