দুঃসময় কবিতার মূলভাব ব্যাখ্যা কর

দুঃসময় কবিতার মূলভাব ব্যাখ্যা কর

দুঃসময়’ কবিতার মূল ভাব আলোচনা করো ।
দুঃসময়’ কবিতার মূল ভাব আলোচনা করো 

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ কবি প্রকৃতি ও মানবের অগণিত প্রকাশের সাথে মানবমনের যে সম্বন্ধ কবি তাকে তীক্ষ্ণ ও গভীর অনুভূতির মধ্য দিয়ে বিচিত্র রস-রূপে উপভোগ করেন। কবিচিত্তে এই বিচিত্র রসভোগের ক্ষুধা প্রবল। 

এই অনুভূতির আবেগ, এই অন্তরের আনন্দবোধকে প্রকাশ করবার তীব্র ব্যাকুলতাই সমগ্র শিল্পসৃষ্টির মূল। রসভোগের ক্ষুধায় চির-বুভুক্ষিত কবির রসচক্রের এক গণ্ডি অতিক্রম করে অন্য গণ্ডিতে প্রবেশের প্রয়াস তার মধ্যে চির বর্তমান। তাই রবীন্দ্রকাব্যে বারবার ঘটেছে পালাবদল।

“চৈতালি' হতে আরম্ভ করে 'কথা' ও 'কাহিনি'র মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র কবিমানসে একটা পরিণতির ধারা পরিলক্ষিত হয়। নিরবচ্ছিন্ন শিল্পীর মাধুর্যময় জীবন হতে— সৌন্দর্য, প্রেম ওজীবনের বিচিত্র রস-সম্ভোগ হতে কবি একটু সরে এসে ত্যাগ, সত্য, ন্যায় ও ধর্মনিষ্ঠা অর্থাৎ কবি জীবনের গভীরতর অংশের দিকে, মানবের শাশ্বত সত্যের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছেন।

ব্যক্তিগত ভোগের মায়াসৌধ চূর্ণ করে, জীবনকে কঠোরভাবে উপলব্ধি করে, মহাজীবনকে লাভের জন্য কবি কঠিন সাধনায় অগ্রসর হচ্ছেন। 'কল্পনা'তে একদিকে রস-সম্ভোগের জীবন হতে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে, অন্যদিকে পূর্বজীবনের সৌন্দর্য ও মাধুর্যের অনুভূতি পূর্ব স্মৃতির পথ বেয়ে প্রকাশিত হয়েছে। 

দুটি ভিন্নমুখী ধারা 'কল্পনা' কাব্যে মিশেছে। একদিকে চির রসভোগ হতে বঞ্চিত হবার বেদনা, পক্ষান্তরে বৃহত্তর, মহত্তর ও গভীরতর জীবনের আহ্বানে সাড়াদান কবির এ রূপান্তরে ভোগ ও ত্যাগের প্রবল দ্বন্দ্ব কবিমানসে দেখা দিয়েছে।

 চিরপরিচিত ও এতদিনকার সাধের প্রেম ও সৌন্দর্যের রাজ্য ছেড়ে অনির্দিষ্ট নতুন পথে যাত্রা করেছেন কবি- 'কল্পনা' কাব্যের 'দুঃসময়', 'বর্ষশেষ' ও 'বৈশাখ' কবিতাত্রয়ের মাধ্যমে কবি পুরাতন ও নতুনের দ্বন্দ্ব অতিক্রমের চিহ্ন রেখেছেন।

'দুঃসময়' কবিতায় কবির দীর্ঘদিনের পরমপ্রিয় রসজীবনের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কবির চিত্ত বিহঙ্গকে চির পরিচিত নীড় ছেড়ে একাকী অজানা অজ্ঞাত পথে নবজীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। অজানা পথে সন্দেহ, সংকোচ ও ভয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিগত জীবন বিচ্ছেদের বেদনা। 

তবুও নির্ভয়ে তাকে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে পড়তে হবে। কারণ তা যে বৃহত্তর জীবনের আহ্বান গণ্ডি থেকে গণ্ডিতে প্রবেশের প্রবল আকা ক্ষায় কবিচিত্ত ব্যাকুল। কবি জানেন নতুন জীবন নিরাশ্রয়-অজ্ঞাত-অমসৃণ-

“কোথা রে সে তীর ফুলপল্লবপুঞ্জিত,

কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্ৰয়শাখা!”

অজানা নতুন পথের ও গন্তব্যের ভয়-সংশয়, তার গোপন কঠিন আকর্ষণ, পক্ষান্তরে পূর্বতনের মায়া কবিচিত্তে প্রবল সংগ্রামের সৃষ্টি করেছে।

কবির সমস্ত জীবন নিয়ন্ত্রণকারী রহস্যময়ী জীবনদেবতার আহ্বান কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হলো, কবি সাহস পেলেন। জীবনদেবতার আহ্বানে নতুন কর্তব্যভার নিয়ে সকল দ্বিধা-সংকোচ- ভয় কবির চিত্ত থেকে উবে গেল, কেবল নতুনের আকাঙ্ক্ষায় কবিচিত্ত ভরপুর। তাই কঠোর কর্মের পথে দুঃখ-বেদনার সাথে যুদ্ধের আহ্বানে কবি ঝাঁপ দিলেন।

“পরপারে উত্তরিতে

পা দিয়েছি তরণীতে

তবুও আহ্বান

নয়নপল্লব, 'পরে

স্বপ্ন জড়াইয়া ধরে,

থেমে যায় গান,

ক্লান্তি টানে অঙ্গে

প্রিয়ার মিনতিসম-

এখনো আহ্বান?”

গত জীবনের জন্য যে একটা ক্ষীণ বেদনা ও নবজীবনের প্রতি সন্দেহ, ভয় ও সংকোচের যা কিছু সামান্য অবশিষ্ট ছিল 'বর্ষশেষ' কবিতায় কালবৈশাখীর উদ্দাম নৃত্যের সাথে তা কোথায় শূন্যে উবে গেল। পুরাতন, জীর্ণ, ক্লান্ত বৎসরের বিদায়ের সাথে কবি তাঁর পুরাতন কাব্যজীবনকে বিদায় দিলেন ও উন্মত্ত কালবৈশাখীকে নবজীবনের প্রতীক বলে বরণ করে নিলেন। 

এ বর্ষশেষের ঝড় কবির অন্তর্জীবনেরই ঝড়। কবির জীবনের এক পর্যায়ের শেষটুকু এই ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, আর এক নতুন পর্যায় উদ্ঘাটিত হলো।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ