চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর।
চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর।

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর।


উত্তর:বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতমবুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্ম হীনযান ও মহাযান- এ দু'ভাগে বিভক্ত হয়। মহাযান থেকে উৎপত্তি হয় বজ্রযান, মন্ত্রযান, কালচক্রযান। বজ্রযান থেকে সহজযান। নানা ভাগে বিভক্ত হলেও সবার মূল উৎস বুদ্ধের মতবাদ। বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হলেও এদের মধ্যে প্রাধান্য পায় হীনযান, মহাযান ও সহজযান। চর্যাপদ সহজযানী বৌদ্ধ পদকর্তাদের দ্বারা রচিত।

চর্যায় যে ধর্মমত বিজ্ঞাপিত তা আশ্চর্য। তাতে বৌদ্ধধর্মের ধ্যানের, পারমিতার, পঞ্চশীলের, পঞ্চব্রতের, মন্ত্রের, অহত্বের কোন কথা নেই। বৌদ্ধ দেব-দেবী, পাপ, দেশনা, দশবিধ, সত্বভূমি, স্তূপ, চৈত্য এগুলো পরিহার করা হয়েছে। কবিগণ গঙ্গা যমুনা বা রবি শশীর মিলনের উপায় নির্দেশ করেছেন। মানবদেহের মেরুদণ্ডের দু পার্শ্বের সাধনাই চর্যার কবি সাধকদের স্বতন্ত্র সাধনা। এর সাথে বৌদ্ধ তন্ত্রেরই নিকট সম্পর্ক বিদ্যমান। বৌদ্ধধর্মের যেসব উপকরণ চর্যায় আছে তা হচ্ছে- মহাযানের ত্রিশরণ, শূন্যতা নির্বাণ, পঞ্চস্কন্দ, বোধি, বিজয়, বজ্রযানের প্রজ্ঞা, উপায়, শূন্যতা, করুণা, মহারস, মহাসুখ, জিনপুর, সমরস, মোক্ষ, নৈরাত্ব, দেবী, যোগাসন, অষ্টসিদ্ধি রস প্রভৃতি। বৌদ্ধ অনাত্মবাদ চর্যায় অবিকৃত । তাছাড়া মূল বৌদ্ধ মতের ত্রিশরণ, শূন্যতা ও নির্বাণ স্বয়ং বুদ্ধ পালন করতেন- তা চর্যায় আছে।

হীনযান ও মহাযানের চরম লক্ষ্যই হচ্ছে নির্বাণ। অস্তিত্বকে অনস্তিত্বে মিলিয়ে ধ্যান নিষ্ঠা, সংযম ও আচার পরায়ণতার দ্বারা স্বয়ং বুদ্ধত্ব লাভের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করতে চায় হীনযান মত। মহাযানেরা পূজা, অর্চনা, মন্ত্র ইত্যাদি দ্বারা মৈত্রী, করুণা, প্রজ্ঞা, উপায় ও বোধিসত্ত্ব অর্জনের মাধ্যমে নির্বাণ পেতে চায়।

চর্যাকারদের মতে শূন্য সাধনা বা নির্বাণ লাভের জন্য প্রয়োজন সহজ পথ। বৌদ্ধধর্মের ত্রিশরণ কাহ্ন পা ১৩ নম্বর চর্যায় বলেছেন, চর্যার কবিদের মূল অবলম্বন মানবদেহের তত্ত্বোপলব্ধি। হীনযান মানুষকে বড় করার চেষ্টা করেছে। মহাযানেরা মানুষকে সর্বনিয়ন্তারূপে ঘোষণা করেছে। চর্যায় দেহ শোধন, মহারসপান, নরনারীর যৌন মিলনজনিত অদ্বয় অবস্থা লাভের বিধান রয়েছে সরহ পা-এর ২২ নম্বরে।

তন্ত্র মতে রস রসায়নেই দেহ অজর অমর হয়।

প্রথম চর্যায় লুই পা চঞ্চল চিত্তকে শান্ত করার জন্য ধমন চমন বা রেচক পুরক দুই পিঁড়িতে বসে শূন্য সাধনা করা আবশ্যক। কিন্তু একাকী এ সাধনা সম্ভব নয়। তাই সাধিকার দরকার। বিশুদ্ধ যোগ নারীবর্জিত সাধনা। বৌদ্ধ যোগীও নারীবর্জিত সাধক। তন্ত্রে নারী অপরিহার্য। তন্ত্রের মৈথুন ও যোগের প্রাণায়াম সহযোগে সহজিয়াদের মিথুনাত্মক যোগ সাধনার উৎপত্তি। চর্যায় সর্বত্র মিথুনাত্মক যোগ বিধৃত।

সহজিয়া পদকর্তারা সহজ স্বরূপকে উপলব্ধি করে মহাসুখে মগ্ন হওয়াই এদের মূল আদর্শ। বাঁকা পথ না ধরে সহজ পথ গ্রহণ করে। এদের মতে গুরুর উপদেশই সব। সহজ সাধনাই চর্যার মূল সাধনা। গুরুর হাতে এ সাধনার চাবিকাঠি। সাধনার দাবাখেলায় সদগুরুর নির্দেশই বিজয়ী হওয়ার উপায়। চঞ্চল মূষিক চিত্তকে সদগুরুর বোধেই নিশ্চল করার কথা বলেছেন ভুসুকু, শবর প্রমুখ। তন্ত্রের বিশেষ অবদান গুরুপদ। ধর্মদেশনায় গুরুর স্থান অতি উচ্চে ।

চর্যার সাধনা সহজ বললেও আসলে তা বাক্যাতীত। গুরু এক্ষেত্রে বোবা ও শিষ্য বধির। অনুভবেই তাকে পাওয়া যায়। চর্যার মূল কথা মানবদেহে বিষ ও অমৃত মিশ্রিত আছে। গুরুর কাছ থেকে জ্ঞান নিয়ে বিষ ও অমৃত চিনে নিয়ে বিষ বর্জন করে অমৃত পান করতে

হবে। এই অমৃত পানেই অজর অমর হয়ে নির্বাণ সম্ভব। যা চর্যার পদকর্তাদের পদেও

উচ্চারিত হয়েছে। চর্যার ধর্মতত্ত্ব মূলত এ ধর্মমতেরই প্রকাশ ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ