বিসর্জন' নাটকে প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বই মুখ্য আলোচনা কর

 বিসর্জন' নাটকে প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বই মুখ্য আলোচনা কর 

বিসর্জন' নাটকে প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বই মুখ্য আলোচনা কর
 বিসর্জন' নাটকে প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বই মুখ্য আলোচনা কর  

উত্তর :সাহিত্যের বিচিত্র শাখার মধ্যে নাটক ভিন্ন শিল্পরীতিতে উপস্থাপিত। বিরোধ বা দ্বন্দ্বই নাটকের মেরুদণ্ড। বিরুদ্ধ শক্তির সংঘাতই নাটকের আত্মা। ঘটনার মাধ্যমে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি, মধ্যবর্তী অংশে দ্বন্দ্ব উচ্চাঙ্গে পৌঁছায়, অতঃপর দ্বন্দ্বের অবসান। 'বিসর্জন' নাটকে দ্বন্দ্ব প্রথাধর্মের সাথে মানবধর্মের তথা মানবতার। শেষ পর্যন্ত মানবতার জয় ঘোষিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বে প্রেমেরই জয় ঘোষিত হয়েছে।

ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্য নিঃসন্তান। রানী গুণবতী দেবীর কাছে সন্তান প্রার্থনা করে এবং শর্ত দেয় যে— ফি বছর শত শত প্রাণীর রক্তে দেবীর চরণ ধুইয়ে দেবে। রানীর নির্দেশে ও মন্দিররক্ষক ব্রাহ্মণ রঘুপতির পরামর্শে অপর্ণা নামক এক নিঃস্ব বালিকার সন্তানতুল্য ছাগশিশু বলি দেওয়ায় অপর্ণা রাজার নিকট সন্তান হারানোর ব্যথা নিয়ে ফরিয়াদ জানায়। রাজা অপর্ণার বেদনা উপলব্ধি করে রাজ্যে প্রাণিহত্যা বন্ধ করে দেয়।

 রঘুপতির শিষ্য জয়সিংহ অপর্ণার বেদনায় চমকে ওঠে, বুঝতে পারে হত্যা অমানবিক, ওদিকে রঘুপতির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মনে জন্ম নেয় দ্বৈধের। রঘুপতির আত্মমর্যাদায় ও জীবিকায় আঘাত লাগায় সে রাজার এ নির্দেশ মেনে নিতে পারে না। রঘুপতি আপন অস্তিত্ব ও ক্ষমতা রক্ষার্থে আশ্রয় নেয় ষড়যন্ত্র, কৌশল ও মিথ্যের। রঘুপতি তার সন্তানতুল্য শিষ্য জয়সিংহকে বলে যে, দেবী রাজরক্ত চায়, ভক্ত হিসেবে তার উচিত রাজরক্তের ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে সে রানী গুণবতীকে রাজার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। গোবিন্দমাণিক্যের অনুজ নক্ষত্র রায়কে রাজা হবার জন্য প্ররোচিত করে বিনিময়ে গোবিন্দমাণিক্যের রক্ত পেতে চায়। 

জয়সিংহ রাজাকে হত্যায় উদ্যত হলে রাজা তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, মূলত দেবী রক্ত চায় না, দেবীর কণ্ঠ অনুকরণ করে রঘুপতি নিজেই রাজরক্ত চায়। রঘুপতি ব্যর্থ হলে রাজার পালিত পুত্র ধ্রুবকে দেবীর পায়ে বলি দিতে ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু রাজার হাতে ধরা পড়ায় সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে, রঘুপতি ও নক্ষত্র রায়ের আট বছরের নির্বাসন ঘোষিত হয়। রঘুপতি দুটো দিন সময় ভিক্ষা চায়। কারণ তার পালিত পুত্র ও ভক্ত জয়সিংহ প্রতিজ্ঞা করেছিল যে- শ্রাবণের শেষরাতে রাজরক্ত এনে দেবে।

নির্বাসনের পথে নক্ষত্র রায় মোগলদের সাথে যোগ দেয় এবং ত্রিপুরা আক্রমণের ঘোষণা দেয়। গোবিন্দমাণিক্য ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ চায় না। তিনি রাজ্য ত্যাগ করতে চান। শ্রাবণের শেষরাতে জয়সিংহ আত্মবিসর্জন দেয় আপন প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে। রাজপুত জয়সিংহ আপন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেবীর পা সিক্ত করে দেয় এবং সেই রক্ত যেন শেষ রক্ত হয় এই তার প্রত্যয়। জয়সিংহের মৃত্যুতে লোভী স্বার্থপর রঘুপতি বুঝতে সক্ষম হয়েছে— সন্তান হারানোর ব্যথা। তাই সে দেবীর নিশ্চল প্রতিমাকে গোমতীর জলে নিক্ষেপ করে, নিজের ভুল বুঝতে পেরে অপর্ণাকে নিয়ে মন্দির ত্যাগ করে। রানী গুণবতী ফিরে আসে রাজার বুকে। রঘুপতি ও রানীর মন থেকে লোভ-হিংসা দূর হয়, বিসর্জিত হয় হিংসার হোলিখেলা ।

প্রেম ও হিংস্রতার মাঝে যে বৈপরীত্য ও চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, তা মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘বিসর্জন' নাটকে। যারা হিংসার পূজারি তারা আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে হিংস্রতা প্রকাশে এবং যারা প্রেমে বিশ্বাসী তারা প্রেমের মাহাত্ম্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য আত্মবিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত নয় -এ সত্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে 'বিসর্জন' নাটকে। তবে শেষ পর্যন্ত হিংস্রতা বিসর্জিত হয়ে প্রেমের বিজয় পতাকা উড়ানো হয়েছে। স্বরগ্রামে পৌঁছেছে কবির মানবতাবোধ ।'বিসর্জন' নাটকের জমিনে যেসব চরিত্র সক্রিয় তারা দুই বিপরীত শ্রেণীতে বিভক্ত। এক অংশে- রঘুপতি, রানী গুণবতী, নক্ষত্র রায় এবং এদেরই বিপরীত কোটিতে রাজা গোবিন্দমাণিক্য ও অপর্ণা। এদেরই মাঝখানে দ্বিধা বিজড়িত জয়সিংহ। পেন্ডুলামের মত দু'দিকে দুলতে দুলতে শেষ পর্যন্ত আত্মবিসর্জনের মধ্যে দুই বিপরীতধর্মী চরিত্রেরা একত্রিত হয়েছে।

নাটকের মূলদ্বন্দ্ব- ধর্মের অর্থহীন অন্ধসংস্কার এবং চিরাচরিত ও যুক্তিহীন প্রথার সাথে নিত্য সত্য মানবধর্ম বা হৃদয়ধর্মের। মিথ্যা প্রথাধর্মবোধের সাথে উদার মনুষ্যত্বের মানুষের রুচি স্বার্থের রক্ষাকবচ প্রথাধর্মের সাথে হৃদয়ের পরম সত্য প্রেমের। হিংসার সাথে অহিংসার। রঘুপতির মধ্যে এই মিথ্যে প্রথাধর্মবোধ ও অন্ধসংস্কার প্রচণ্ড শক্তিতে প্রোথিত, রানী গুণবতীর স্বার্থ বিজড়িত সংস্কার ও প্রথামূলক ধর্মবোধ তার সাহায্যকারী; এর সাথে যুক্ত হয়েছে নক্ষত্র রায়ের রাজ্যলোভ। এই দলের সমস্ত চিন্তা, কৌশল, ষড়যন্ত্র কর্ম রঘুপতির মস্তিষ্কজাত। রঘুপতি মন্দিরের ক্ষমতা ধরে রাখতে, আপন স্বার্থ বজায় রাখতে- ধর্মের দোহাই দিয়ে, দেবীর কথা বলে- স্বামী-স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব, ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তের খেলার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে। পক্ষান্তরে, রাজা গোবিন্দমাণিক্য উদার সত্যধর্ম, চিরন্তন হৃদয়ধর্ম, মানবধর্মে অটল পর্বতের মত দণ্ডায়মান। তার পাশে হৃদয়হীন প্রথাধর্মের জীবন্ত প্রতিবাদ স্বরূপিণী, প্রেম ও হৃদয়বত্তার মূর্তিমতি প্রতীক অপর্ণা ।

রানী একটি ক্ষুদ্র প্রাণের জন্য ব্যাকুল। এই ব্যাকুলতার উৎস অপত্য প্রেম। কিন্তু দ্বন্দ্বের মূল এখানে যে এই প্রাণ লাভের জন্য রানী শত শত প্রাণ ধ্বংস করতে প্রতিজ্ঞ ও বদ্ধপরিকর। রানীর অপত্য প্রেমকে অবলম্বন করে রঘুপতি প্রথাধর্মের নাম করে শুরু করেছে স্বার্থসিদ্ধির ভয়ঙ্কর খেলা। প্রাণের প্রতি স্নেহ প্রেম মানুষের স্বভাবজাত হৃদয়ধর্ম, নিত্য সত্যধর্ম। কিন্তু বলিরূপ অন্ধ সংস্কার তাকে রুদ্ধ করেছে। ছাগবলি নাটকে বিরোধের বীজ। এ বীজ বিস্তৃতি পেলো রাজার মনে। তারপর বর্ষিত, পল্লবিত হল রাজার আদেশ। এ ভাবের বীজ জয়সিংহের প্রশান্ত নিস্তরঙ্গ মনে ঢেউ তোলে।

 আচারনিষ্ঠ জয়সিংহের কুয়াশাচ্ছন্ন, মানসগগনে নতুন বিদ্যুৎ চমকে গেল। জয়সিংহের মনে প্রশ্ন জাগল — ধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠান না মানবের হৃদয়ধর্ম সত্য? রঘুপতি না অপর্ণা? শেষ পর্যন্ত মানবতা বা মানবধর্মই তার কাছে প্রাধান্য পেল, তবে দীর্ঘদিনের জঞ্জাল সরাতে বৃহৎ ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সে বুকের রক্ত ঢেলে দিল। প্রথাধর্মের হল অবসান। মানবধর্মের জয়-জয়কার। হিংসা-লোভ-স্বার্থ ভুলে সবাই ঠাঁই নিল মানবধর্মের সত্য ছায়ায় ।

রঘুপতি তার স্বার্থ ও ক্ষমতা রক্ষায় রানী গুণবতীর সন্তান কামনাকে কাজে লাগিয়েছে। অপর্ণার সন্তানতুল্য ছাগশিশু হত্যার অভিযোগে রাজা গোবিন্দমাণিক্য জ্ঞান করে যে, মা এসে তাকে রক্তপাতে নিষেধ করেছে। তাই রাজ্যে বলি বন্ধ ঘোষিত হয়। ছলে-বলে- কৌশলে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে রঘুপতি হিংস্র হয়ে ওঠে। রাজহত্যায়, ভ্রাতৃহত্যায় প্ররোচিত করে । জয়সিংহ শেষ পর্যন্ত আপন বুকের রক্ত ঢেলে দেয়। রঘুপতি সন্তান হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়ে।

 জলে নিক্ষেপ করে দেবীমূর্তিকে। সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। রঘুপতি মানবী দেবী অপর্ণার হাত ধরে মন্দির ছেড়ে চলে যায় মাটির ঘরে। রানী গুণবতী ফিরে পায় তার প্রাণের দেবতাকে। নেমে আসে মানব প্রেম, দাম্পত্য প্রেম। প্রথাধর্ম ও প্রতাপ দর্প অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে প্রেমের বন্যা প্রবাহিত হয় সবার হৃদয়ে। রক্তের স্থলে ফুল হয় শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও প্রেম প্রকাশের উপকরণ। মানবতা ও প্রেম বিজয় পতাকা তুলে ধরে, প্রতাপ অহংকার ও দর্প চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ