বিসর্জন' নাটক অনুসারে জসিংহ ও অপর্ণা চরিত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর

বিসর্জন' নাটক অনুসারে জসিংহ ও অপর্ণা চরিত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর

বিসর্জন' নাটক অনুসারে জসিংহ ও অপর্ণা চরিত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর
বিসর্জন' নাটক অনুসারে জসিংহ ও অপর্ণা চরিত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর


উত্তর :'বিসর্জন' (১৮৯০) রবীন্দ্র নাট্যসহি তার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ নাটকের লক্ষণাক্রান্ত ও বস্তুধর্মিতার কিঞ্চিৎ স্বাক্ষরযুক্ত। নাটকের মূল চল ধর্মের অর্থহীন কুসংস্কার :- যুক্তিহীন প্রথার সঙ্গে নিত্য সত্য মানবধর্ম বা হ্রদ ধর্মের। মিথ্যা ধর্মবোধের সঙ্গে উদার মনুষ্যত্বের, মানুষের স্বার্থকেন্দ্রিক আচারবিধির সঙ্গে হৃদয়ের পরম সত্যপ্রেমের, হিংসার সঙ্গে অহিংসার ।

মূল প্রতিপাদ্য বিষয় গড়ে উঠেছে অপর্ণার ছাগশিশু বধের কাহিনীকে কেন্দ্র করে। ফলে নাটকের জমিনে নড়তে চড়তে হয়েছে বলি প্রথার পক্ষে ও বিপক্ষে বেশকিছু চরিত্রকে। সেদিক বিবেচনায় নাটকের প্রধান অপ্রধান সব চরিত্রই কমবেশি গুরুত্ববহ।নাটকের মূল প্রতিপাদ্যকে স্পষ্ট করতে তথা হৃদয়ধর্ম ও মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকতে হয়েছে জয়সিংহকে। জয়সিংহ মূলত রাজতনয়। তবে সে মন্দিরের পুরোহিত রঘুপতির পালকপুত্র। ফলে ছেলেবেলা থেকেই সে বলিদানে বিশ্বস্ত। কিন্তু তার চরিত্রের মূল উপাদান প্রেম ও মানবিকতা। তাই দরিদ্র তনয়া অপর্ণা যেদিন রাজার কাছে ছাগশিশু বধের জন্য কৈফিয়ত চেয়েছে, তখনই জয়সিংহের মধ্যেকার ঘুমন্ত প্রেমবোধ জেগে উঠেছে। আঘাত হেনেছে তার আবাল্য লালিত সংস্কারে। অনাবিষ্কৃত অথচ প্রত্যাশিত দিক উন্মোচিত হয়েছে। জয়সিংহ পতিত হয়েছে সমস্যায়। চরিত্রে দেখা দিয়েছে সংকট। দেবী কি সত্যি রক্ত চান? তার হৃদয় হয়েছে চৌচির। তাই রঘুপতির রাজহত্যার আয়োজনকালে সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু গুরুভক্তি, কৃতজ্ঞতা তাকে বিচলিত করেছে। প্রবল দ্বন্দ্বে জয়সিংহের কাছে সব মিথ্যে বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।

একপর্যায়ে সব চিন্তার জাল ছিন্ন করে জয়সিংহ গুরুভক্তিতে শ্রদ্ধাশীল হয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হল যে, সে শ্রাবণের শেষ রাতে রাজরক্ত এনে দেবে। কিন্তু রঘুপতির ছলনা যখন তার কাছে ধরা পড়ল, সে যখন জানতে পারল যে দেবী মূলত রাজরক্ত চায় না- আসলে রঘুপতি কণ্ঠ আড়াল করে ছলনা করে, তাছাড়া দেবী মুখ ফিরিয়ে রাখে নি, রঘুপতি নিজ হাতে দেবীর মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, তখনই তার দ্বিধা কেটে গেল ।

দেবীর ওপর তার প্রচলিত ভক্তি বিশ্বাস উবে গেলেও রয়ে যায় ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির বন্ধন। পিতৃতুল্য পালক-পিতার সঙ্গে সন্তানের বন্ধন। জয়সিংহের পক্ষে সে বন্ধন ছিন্ন করা সম্ভব নয়। কারণ সে সরল, অকপট, সত্যবাদী। ফলে রঘুপতিকে দেয় প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে সে বদ্ধপরিকর।

তাছাড়া এ নাটকে প্রথাধর্মবিশ্বাসী তার গুরু রঘুপতিকে শিষ্য হয়েও সে শিক্ষা দিতে চায় যে- লোভ, হিংসা আর প্রথাধর্মের চেয়ে হৃদয়ধর্ম বড়। হিংসার চেয়ে প্রেম বড়। সর্বগ্রাসী রঘুপতি তার সন্তানের রক্ত না পাওয়া পর্যন্ত অপর্ণার ব্যথা বুঝবে না। তাই তার শরীরে প্রবাহিত যে রাজরক্ত তা আত্মহননের মধ্য দিয়ে গুরুপদে সমর্পণ করে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে। আপন সন্তান বিয়োগে রঘুপতির চৈতন্য উদয় করতে সে আত্মবিসর্জন দেয়।

নাটকের মূলকথা হত্যার মাধ্যমে কখনো কল্যাণ আসতে পারে না। হত্যা, রক্ত অকল্যাণেরই স্বাক্ষর। কোন নিরপরাধ জীবনকেই দেবীর ইচ্ছেয় বলি দেওয়া উচিত নয়। এ চিন্তা মূলত জন্ম নেয় জয়সিংহের মস্তিষ্কেই। ঋষিতুল্য রাজাকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যতে প্রাণিহত্যা রোধে সে নিজের রক্ত দিতে প্রয়াস পায় ।

জয়সিংহের নির্মম আত্মদান স্তব্ধ করে দেয় রঘুপতিকে। তার কাছে মিথ্যে হয়ে যায় দেবীর আরাধনা, শূন্য মনে হয় মন্দিরপীঠ। রঘুপতি বুঝতে পারে মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের বাস -প্রাণই মূল্যবান, পাষাণ মূর্তি অর্থহীন। তাই বিসর্জন দেয় পাষাণ মূর্তিকে, বিসর্জিত হয় হিংসা রক্ত। যা নাট্যকারের মূল প্রতিপাদ্য। সে দিক বিবেচনায় নাটকের সর্বৈব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে জয়সিংহের ভূমিকা অনবদ্য।

অপর্ণা 'বিসর্জন' নাটকে রহস্যময়ী অস্পষ্ট রূপক নারী চরিত্র। সে দরিদ্র কিন্তু মানবিকতায় স্পষ্ট। ফলে তার সন্তানরূপ ছাগশিশুর জন্য আর্তনাদ। নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়ের সূতিকাগার অপর্ণা। যে শক্তি নাটকে জয়ী হল, সেই স্নেহ প্রেমের ভাবমূর্তি অপর্ণা। তার শক্তি নাটকে প্রলয়ঙ্করী শক্তিরূপে অভিব্যক্ত। তার মানবিক Concept অদৃশ্য প্রেরণা হয়ে প্রভাব ফেলেছে সমস্ত চরিত্রে। রঘুপতি ও রানীর বিরুদ্ধাচরণ শক্তিশালী হয়েছে অপর্ণার মানবিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তার প্রভাবে জয়সিংহের চরিত্র অলক্ষ্যে ভেঙেছে, গড়েছে ও নির্মাণ করেছে। রাজাকে স্বপ্ন হতে জাগরিত করেছে। তার মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে মানবমুখীনতায় ।

রঘুপতিকেও সে দূর থেকে পরোক্ষভাবে আকর্ষণ করে তার ওপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছে। নাটকে পরোক্ষভাবে অপর্ণারই জয় হয়েছে।

অপর্ণার যে বেদনা তা নাট্যকারেরও বেদনা। এই বেদনাকে কেন্দ্র করেই স্বার্থের সঙ্গে প্রেমের দ্বন্দ্ব, হিংসার সঙ্গে প্রেমের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের মুখপাত্র অপর্ণা। অপর্ণার বেদনা দিয়েই বিশ্ববেদনা উচ্চারিত হয়েছে। অপর্ণা জাগিয়ে তুলেছে সবার মধ্যেকার ঘুমন্ত মানবতা। এমনকি শেষ পর্যন্ত তারই চৈতন্যের আকর্ষণে আত্মাহুতি দিয়েছে জয়সিংহ। জয়সিংহঅপর্ণার অভিপ্রায়কে

গুমরানো ব্যথাকে উপশম করতে অপণার কাছ থেকে দূরে থেকেছে। অপর্ণার জন্যই সে অপর্ণাকে ছেড়েছে। প্রকারান্তরে অপর্ণার ইচ্ছেই পূর্ণ হয়েছে। রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় নাটকের মূল অভীষ্ট উচ্চারণে, সবার মন থেকে হিংসা বিসর্জন দেওয়ার পেছনে অপর্ণার ভূমিকাই মুখ্য। সেদিক বিবেচনায় অপর্ণার চরিত্র

গুরুত্ববহ।

অপর্ণার চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ