বিসর্জন' নাটক অবলম্বনে অপর্ণার চরিত্র বিশ্লেষণ কর
বিসর্জন' নাটক অবলম্বনে অপর্ণার চরিত্র বিশ্লেষণ কর
![]() |
বিসর্জন' নাটক অবলম্বনে অপর্ণার চরিত্র বিশ্লেষণ কর |
উত্তর: চিরাচরিত সনাতন প্রথাধর্মের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামী উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) 'বিসর্জন' কাব্য নাটকটি রচিত। পুঁথিগত আচরণ সর্বস্ব ধর্মের বিরুদ্ধে মানবধর্ম নামক বিশ্বধর্মের প্রতীকে একটি ধর্মকে দাঁড় করিয়ে দু'য়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে এ নাটকে। 'বিসর্জন' নাটকে যে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে তার উৎস অপর্ণা।
অপর্ণার চৈতন্য আলোক দ্বারা রাজা গোবিন্দমাণিক্য ও জয়সিংহ আলোকিত হয়ে নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়কে পরিণতি ও সম্পূর্ণতা দিয়েছে। অপর্ণাই এ নাটকে প্রকৃত মাতৃবৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ মা-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ।
অপর্ণা রহস্যময়ী অস্পষ্ট রূপক নারী চরিত্র। এ ধরনের চরিত্র রূপক সাংকেতিক নাটকে অধিকতর শোভা বর্ধন করে। সে দরিদ্র তনয়া কিন্তু মানবিকতায় স্পষ্ট। যে শক্তি নাটকে জয়ী হল, সেই স্নেহ প্রেমের ভাবমূর্তি অপর্ণা। তার শক্তি নাটকে প্রলয়ঙ্করী শক্তিরূপে অভিব্যক্ত। সে নাটকের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, ঘটনার বাইরে দাঁড়িয়ে অদৃশ্যলোক হতে নাটকের মধ্যে তার অমোঘ প্রভাব নিক্ষেপ করেছে। 'চোখের বালি' উপন্যাসে রাজলক্ষ্মী যেমন ভিতর থেকে কাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেছে,
তেমনি অপর্ণা বাইরে থেকে নাটকের দ্বন্দ্ব- সংঘাত সৃষ্টি করেছে । নাটকের মধ্যে দু'একবার তার উপস্থিতি ঘটলেও তা সামান্য সময়ের জন্য, ছায়ার মত। তার মানবিক Concept অদৃশ্য প্রেরণা হয়ে প্রভাব ফেলেছে সমস্ত চরিত্রে।
রঘুপতি ও রানীর বিরুদ্ধাচরণ শক্তিশালী হয়েছে অপর্ণার মানবিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তার প্রভাবে জয়সিংহের চরিত্র অলক্ষ্যে ভেঙেছে, গড়েছে ও নির্মাণ করেছে। রাজাকে স্বপ্ন হতে জাগরিত করেছে। তার মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে মানবমুখীনতায়। “বালিকার মূর্তি ধ’রে
স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন,
জীবরক্ত সহে না তাঁহার।” (১ম অংক, ২য় দৃশ্য)
রঘুপতিকেও 'সে দূর থেকে পরোক্ষভাবে আকর্ষণ করে তার ওপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছে। নাটকে পরোক্ষভাবে অপর্ণারই জয় হয়েছে।
অপর্ণার মানবিক অংশ অপরিস্ফুট ও ক্ষীণ। সে একটা ছায়ামূর্তি বলে মনে হয় । সে যেন ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ'-এর রঘু দুহিতারই আর একরূপ। জয়সিংহের প্রতি তার প্রেমের পূর্বাপর উদ্ভব ও পরিণতি নেই, আবেগের স্পন্দন, চিত্তদ্বন্দ্ব কিছুই তার নেই। তার সমস্ত কর্ম অন্তরের মধ্যে একটা ভাবের উদ্বোধনের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত। নাটকের মূল প্রত্যয় প্রেম— তা যেমন উপলব্ধিজাত ধরাছোঁয়ার বাইরে বিমূর্ত তেমনি নাটকে অপর্ণার শারীরিক অবয়ব থাকলেও মূলত তার চরিত্র বিমূর্ত উপাদানে নির্মিত। অপর্ণা যেন অবরোধিত বিকৃত মানুষের অন্তরাত্মার মুক্তি।
মানুষের মধ্যে যে পশুত্ব যা দেহকে রক্ষা করে, প্রাণকে গলা টিপে মেরে বস্তু বিশ্বকে অধিকার করে, বিজয়োল্লাসে টিকে থাকে তাকে আঘাত করে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করার কর্মে
নিয়োজিত অপর্ণা।
অপর্ণার কাজ হচ্ছে রঘুপতি ও রানী যে মন্দির অন্ধত্বে আলগে আছে— সেই মন্দিরে ঢুকে অন্ধত্বের জাল মোচন করে সেখান থেকে বাইরে বিশ্বমানবতার প্রেমের স্নিগ্ধ সমীকরণে।
পিও সোনা রূপা নয় বরং মাটির উপরে একটুখানি ঘাসফুল ফোটানোই তার কাজ। প্রাণের এই জাদু নিয়ে প্রাণকে উত্তেজিত করায় তার চারিত্রিক সার্থকতা। অপর্ণা রাজা ও
জয়সিংহের অন্তর্দ্বন্দ্বের সূতিকাগার। এক সত্তার সঙ্গে অন্য সবার জন্য বিয়েরপ্রেম যেমন অনির্বচনীয়- অপর্ণার চরিত্রও তেমনি অবর্ণনীয়। অপর্ণা প্রেমের প্রতীক প্রাণের মধ্যে প্রেমের প্রকাশ। অফুরন্ত শক্তি, সাহস, ছন্দায়িত গতিবেগ, মঙ্গলের সর্বদাপী অনুভূতি কল্যাণের বিশুদ্ধ উপলব্ধি যা মানবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, দেব অংশের নিত্য স্বভাব।
অপাপবিদ্ধ, অহংমুক্ত। লীলাময় প্রাণের প্রতীক। প্রেমের সহজ প্রকাশ। আনন্দের কল্যাণের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি। সর্ববন্ধনহীন মুক্তির আধার। প্রেম ও মুক্তি একটি নারীমুক্তির মধ্যে রূপায়িত । অপর্ণা প্রাণলীলারস মূর্তি।
অপর্ণার যা স্বরূপ 'বিসর্জন'-এ তা প্রতিপাদ্য। অপর্ণা 'বিসর্জন' নাটকে রহস্যময়ী অস্পষ্ট রূপক নারী চরিত্র। সে দরিদ্র কিন্তু মানবিকতায় স্পষ্ট মাতৃত্ববোধে পূর্ণা। ফলে তার সন্তানরূপ ছাগশিশুর জন্য আর্তনাদ। নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়ের সূতিকাগার অপর্ণা।
যে শক্তি নাটকে জয়ী হল, সেই স্নেহ প্রেমের ভাবমূর্তি অপর্ণা। তার শক্তি নাটকে প্রলয়ঙ্করী শক্তিরূপে অভিব্যক্ত। তার মানবিক চৈতন্য অদৃশ্য প্রেরণা হয়ে প্রভাব ফেলেছে সমস্ত চরিত্রে।
রঘুপতি ও রানীর বিরুদ্ধাচরণ শক্তিশালী হয়েছে অপর্ণার মানবিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তারই প্রভাবে জয়সিংহের চরিত্র অলক্ষ্যে ভেঙেছে, গড়েছে ও নির্মাণ করেছে। রাজাকে স্বপ্ন হতে জাগরিত করেছে। তার মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে মানবমুখীনতায়।
রঘুপতিকেও সে দূর থেকে পরোক্ষভাবে আকর্ষণ করে তার ওপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছে। নাটকে সে সর্বস্বান্ত হয়েছে- সে তার সন্তান তুল্য ছাগশিশু হারিয়েছে, প্রেমিক প্রবর, সমমনা বন্ধু জয়সিংহকে হারিয়েছে। তবুও নাটকে অপর্ণাই জয়ী হয়েছে।
অপর্ণার যে বেদনা তা নাট্যকারেরও বেদনা। এই বেদনাকে কেন্দ্র করেই স্বার্থের সাথে প্রেমের দ্বন্দ্ব, হিংসার সাথে প্রেমের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের স্রষ্টা অপর্ণা। অপর্ণার বেদনা দিয়েই বিশ্ব বেদনা উচ্চারিত হয়েছে। অপর্ণা জাগিয়ে তুলেছে সবার মধ্যেকার ঘুমন্ত মানবতা।
এমনকি শেষ পর্যন্ত তারই চৈতন্যের আকর্ষণে আত্মাহুতি দিয়েছে জয়সিংহ। জয়সিংহ অপর্ণার অভিপ্রায়কে, গুমরানো ব্যথাকে উপশম করতে সে অপর্ণার জন্যই অপর্ণাকে ছেড়েছে। প্রকারান্তরে অপর্ণার ইচ্ছেই পূর্ণ হয়েছে। রক্তপাত বহু হয়েছে।
সে দিক বিবেচনায়- নাটকের মূল অভীষ্ট উচ্চারণে, সবার মন থেকে হিংসা বিসর্জন দেওয়ার পেছনে অপর্ণার ভূমিকাই মুখ্য। সে দিক বিবেচনায় 'বিসর্জন' নাটকে অপর্ণা চরিত্র বিশেষ মাত্রায় অঙ্কিত।