বিসর্জন' কাব্যনাট্যে কে কী বিসর্জন দিয়েছেন কার্যকারণ ও পরিণাম নির্দেশ করে আলোচনা কর
বিসর্জন' কাব্যনাট্যে কে কী বিসর্জন দিয়েছেন কার্যকারণ ও পরিণাম নির্দেশ করে আলোচনা কর
![]() |
বিসর্জন' কাব্যনাট্যে কে কী বিসর্জন দিয়েছেন কার্যকারণ ও পরিণাম নির্দেশ করে আলোচনা কর |
উত্তর :চিরাচরিত সনাতন প্রথা ও ধর্মের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামী উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন' কাব্যনাট্যটি রচিত। পুঁথিগত আচরণসর্বস্ব ধর্মের বিরুদ্ধে মানবধর্ম নামক একটি ধর্মকে দাঁড় করিয়ে দু'য়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে এ নাটকে ।
ত্রিপুরার রানী নিঃসন্তান গুণবতী ক্ষুদ্র প্রাণের জন্য ব্যাকুল, তাকে স্নেহ ভালবাসা দিয়ে জীবন সার্থক করতে চায়, কিন্তু প্রাণ লাভের জন্য শত শত প্রাণ ধ্বংস করতে সে উদ্যত। অপর্ণার সন্তানতুল্য ছাগশিশু বলি দিলে সে রাজার কাছে আবেদন জানায়। রাজা তার রাজ্যে বলি বন্ধ ঘোষণা দেয়। শুরু হয় প্রথাধর্মের ধারক বাহক রঘুপতির সাথে মানবধর্মের প্রতিভূ গোবিন্দমাণিক্যের দ্বন্দ্ব। ব্রাহ্মণ রঘুপতির বিশ্বাস ধর্ম রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার উপর অর্পিত।
রাজার আদেশে মন্দিরে পূজার বলি নিষিদ্ধ হলে রঘুপতির তেজ, গর্ব ও দত্ত চূর্ণ হয়, সে ক্রোধে জ্বলে ওঠে, ক্রোধাগ্নি ছড়িয়ে দেয় সর্বস্তরে, সকলকে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে। যুবরাজ নক্ষত্র রায়কে সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে রাজহত্যায় প্ররোচিত করে, পুত্রতুল্য শিষ্য জয়সিংহকে বোঝায়- “রাজরক্ত চাই দেবীর আদেশ।” জয়সিংহ রাজহত্যায় ব্যর্থ হলে রঘুপতি আবার জ্বলে ওঠে, জয়সিংহকে দিয়ে দেবীর পা স্পর্শ করিয়ে প্রতিজ্ঞা করাতে সক্ষম হয়, জয়সিংহ প্রতিজ্ঞা করে- “আমি এনে দেব রাজরক্ত শ্রাবণের শেষ রাতে দেবীর চরণে।”
তাতেও রঘুপতি শান্ত হয় না, তারই চক্রান্তে মন্দিরের প্রস্তর নির্মিত জড় প্রতিমার মুখ ফিরে যায় এবং সমস্ত ধর্মভীরু প্রজার মনে ভীতি ও শঙ্কা সৃষ্টি হয়। সে তার অভিপ্রায় চরিতার্থে অবিচল, নিঃশঙ্ক, নিরন্তর সচেষ্ট। তার সমস্ত চক্রান্ত রাজার কাছে ধরা পড়ে গেলে রঘুপতির আট বছরের নির্বাসন দণ্ড হয়। বুকের মধ্যে তার পরাজয়ের জ্বালা হু হু করে জ্বলতে থাকে।
তার শিষ্যের প্রতি অগাধ বিশ্বাস — শ্রাবণের শেষ রাতে রাজরক্ত এনে দেবে। সে বিশ্বাস তার অটুট। মন্দিরের বাইরে সর্বনাশের ঝড় উঠেছে। হয় রাজা, না হয় রঘুপতি এ ঝড়ে শুকনো পাতার মত উড়ে যাবে। কিন্তু না, বিশ্বাসের পাথরে খোদাই রঘুপতির চোখ, ধর্মবিশ্বাসে। কিন্তু তার পুত্রতুল্য শিষ্য যখন আত্মবিসর্জন দিয়ে রক্ত এনে দিয়েছে তখনই তার চৈতন্য ফিরে এসেছে। পাষাণস্তূপ দেবীকে জলে নিক্ষেপ করে মানবী দেবী অপর্ণার হাত ধরে মন্দির ছেড়েছে।
'বিসর্জন' নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো জয়সিংহ, অপর্ণা, রঘুপতি, গুণবতী, গোবিন্দমাণিক্য— প্রত্যেকেই কোন না কোন ধরনের বিসর্জন দিয়েছে।
অপর্ণাকে তার সন্তানতুল্য ছাগশিশুদ্বয়কে বিসর্জন দিতে হয়েছে যাকে কেন্দ্র করে নাটকের প্রথাধর্মের সাথে মানবধর্মের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। রাজ্যে বলিদান নিষিদ্ধ হয়েছে।
জয়সিংহ মন্দির সেবক। রঘুপতি তার পিতৃতুল্য গুরু। জয়সিংহের চির বিশ্বাস মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবী জাগ্রত এবং বলি তার পাওনা। কিন্তু অপর্ণা যখন বলেছে যে, মা-এর কাজ সন্তানের জীবন দান, জীবন বিনাশ নয়। সন্তানের রক্ত পান করে যে, সে রাক্ষুসী। তখন জয়সিংহ হয়েছে দ্বিধান্বিত। প্রথাধর্মের সাথে তার মধ্যেকার মানবধর্মের সংঘাত শুরু হয়। গুরু রঘুপতির কাছ থেকে সে জেনেছে যে, দেবী রাজরক্ত চায়। সে গুরুকে প্রতিশ্রুতি দেয়— শ্রাবণের শেষ রাতে রাজরক্ত এনে দেবে। কিন্তু গোবিন্দমাণিক্যকে হত্যায় তার হাত কাঁপে। তদুপরি সে বুঝতে পারে তার গুরুর ষড়যন্ত্র। তবুও গুরুর ও দেবীর কাছে প্রদত্ত প্রতিজ্ঞা অনুসারে সে তার চৈতন্যের উৎস অপর্ণাকে প্রাপ্তির লোভ বিসর্জন দিয়ে নিজের বুকের রক্ত দেয় তথা আত্মবিসর্জন দেয় এই বলে যে- এই হোক শেষ রক্ত দান। জয়সিংহের আত্মবিসর্জন নাটকের গ্রন্থি মোচনের, দ্বন্দ্ব নিরসনের সূতিকাগার। যে বিসর্জনের ফলে হিংস্র রঘুপতি সন্তানহারা বেদনা উপলব্ধি করে এক উল্লম্ফনে দীর্ঘদিনের লালিত প্রতিমা, মন্দিরে স্থাপিত দেবীমূর্তিকে গোমতীর জলে বিসর্জন দেয়। রঘুপতির প্রতিমা বিসর্জন আমাদেরকে টেনে নিয়ে যায় নাটকের পাত্রপাত্রীর হৃদয় দোরে এবং চৈতন্যের গভীরে আলো ফেলে আমাদের দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন করে। যে রঘুপতির দীর্ঘদিনের লালিত ভক্তি, আত্মঅহমিকা, গর্ব ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিংস্রতার পথকে প্রশস্ত করেছে, অন্যান্য চরিত্রকে করে তুলেছে হিংস্র- সেই রঘুপতির মন থেকে বিসর্জিত হয়েছে হিংস্রতা, প্রেমের অনুভূতি সেখানে দানা বেঁধেছে। চির ঘৃণ্য অপর্ণার হাত ধরে চির লালিত মন্দির ত্যাগ
করেছে।সহযোগী হিসেবে রানীর মন থেকেও হিংসা, স্বার্থপরতা বিসর্জিত হয়েছে। উপলব্ধি এসেছে, যে মাতৃত্ব তার কাম্য, তার জন্য অন্য মায়ের কোল শূন্য করে নয়। অর্থাৎ স্বার্থপর মাতৃত্ব বিসর্জিত হয়েছে। সকল গোঁড়ামিকে বিসর্জন দিয়ে প্রেমের পথে ফিরে এসেছে। যে পাষাণকে রাজ্যের সকল ধর্মপ্রাণ জনগণ দেবী বলে মানত জানত এবং তার পায়ে বর্ষে বর্ষে বলি দিত, সেই দেবীমূর্তি জনমন হতে বিসর্জিত হয়েছে। বলিপ্রথাও রাজ্য হতে বিসর্জিত হল। প্রস্তর মূর্তি দেবীর স্থলে মানবদেবীর ঘটেছে আগমন, গেছে পাপ। দেবী আজ এসেছে ফিরে আমার দেবীর মাঝে ।
উহ্য থাকলেও আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, নক্ষত্র রায়ের মধ্যে রাজ্যলোভের যে মোহ জন্মেছিল, সে মোহও বিসর্জিত হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্বের হয় বিসর্জন।
মূলত এ নাটকে জয়সিংহের আত্মবিসর্জনই মুখ্য। তার এ বিসর্জনকে কেন্দ্র করে নাটকের জমিনে যেসব চরিত্রের মনে লোভ-মোহ-গর্ব-দর্প-জিঘাংসা প্রভৃতি অমানবিক প্রবৃত্তি এবং প্রথাধর্ম ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দানা বেঁধেছে, যা মানুষের মধ্যে পশুত্বকে জাগিয়ে তুলে, তেমনি সর্বৈব নেতিবাচক উপাদানগুলো বিসর্জিত হয়েছে।
কাহিনী বিনির্মাণে দক্ষ নাট্যকার মানবিক ও অমানবিক প্রবৃত্তিগুলোকে ঘটনার যৌক্তিকতায় চরিত্রে প্রোথিত করেছেন। আবার জেলে যেমন ছড়ানো জালের সমস্ত শাখাগুলো একটানে গুটিয়ে ফেলে, তেমনি নাট্যকার যুক্তিনিষ্ঠভাবে সমস্ত চরিত্রের নেতিবাচক উপাদান বিসর্জনে পারম্পর্য সম্পর্ক দেখাতে সক্ষম হয়েছেন ।