বাংলা নাথসাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখ
বাংলা নাথসাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখ।
![]() |
বাংলা নাথসাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখ। |
উত্তর: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য প্রধানত বিভিন্ন ধর্ম ও উপধর্ম সম্প্রদায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শাক্ত, শৈব, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব — এগুলো প্রধান ধর্ম সম্প্রদায়। এই মিশ্র ধর্মচেতনা সারা মধ্যযুগকেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের সাথে শৈব ধর্মের মিলনে সৃষ্ট ধর্মমতই নাথধর্ম বা নাথপন্থা।
নাথসাহিত্য নাথধর্মের প্রচার বিষয়ক সাহিত্য। নাথপন্থীদের যোগমাহাত্ম্য এবং ক্রিয়াকাণ্ডের বিবরণ নিয়ে রচিত সাহিত্যকেই নাথসাহিত্য বলে। নাথপন্থীরা জড়দেহকে মুক্তির বাধা না বলে, সোপান হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
তাঁরা নানা ধরনের যৌগিক, তান্ত্রিক, রাসায়নিক, আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত ভেষজবিদ্যার সাহায্যে জড়দেহকে পরিশুদ্ধ বা পরিপক্ক করে তার সাহায্যে মোক্ষমুক্তি নির্বাণ লাভের আকাঙ্ক্ষা করতেন। যোগের দ্বারা নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে তারা পাঞ্চভৌতিক জড়দেহকে অপার্থিব দিব্যদেহে পরিণত করতেন। এরা মূলত আত্মবাদী। সাধন প্রক্রিয়া দ্বারা নিজের মোক্ষলাভ এদের সাধনা।
শিব এদের আদি গুরু—তিনিই আদি নাথ। তাঁর শিষ্য মীননাথ, মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ। রানী ময়নামতী এবং তার একমাত্র সন্তান গোপীচন্দ্র গোপীচন্দ্রকে নিয়ে কিছু ছড়া পাঁচালি ও কাব্যকাহিনী লেখা হয়েছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মীননাথের সময় সপ্তম শতকের মধ্যভাগ বলে মনে করেন। সাধারণত দশম থেকে একাদশ শতক নাথ আচার্যদের আবির্ভাবকাল মনে করা হয়। এ সময়েই নাথসাহিত্যের বিকাশ ঘটে। মীননাথ, গোরক্ষনাথ, ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের নানা লৌকিক ও অলৌকিক কাহিনী মিলে নাথ সাহিত্য গড়ে ওঠে। নাথ সাহিত্যের লিখিত পুঁথি অষ্টাদশ শতকের আগে পাওয়া যায় নি।
নাথ সিদ্ধাচার্যদের কাহিনী বহুকাল মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। প্রধানত নাথসম্প্রদায়ের জন্য এ সাহিত্যের সৃষ্টি। এতে সিদ্ধাচার্যদের
জীবনের অলৌকিক কাহিনী থাকলেও পরবর্তীতে এ সাহিত্য সম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে মানবিক আবেদনে সকল সম্প্রদায়ের কাছেই সমাদৃত হয়।
নাথসাহিত্যের কাহিনী প্রধানত দু'ভাগে বিভক্ত। একটিতে গোরক্ষনাথ কর্তৃক মীননাথকে নারী মোহ থেকে উদ্ধার এবং অপরটিতে ময়নামতী ও তার পুত্র গোপীচন্দ্রের কাহিনী স্থান পেয়েছে।
গোরক্ষবিজয় : গোরক্ষনাথ কর্তৃক পথভ্রষ্ট শুরু মীননাথকে উদ্ধার করার কাহিনী নিয়ে এদেশে দু'রকমের বই লেখা হয়েছে। একটি গোরক্ষবিজয় বা গোর্থবিজয়, অপরটি মীনচেতন। দুটির বিষয় একই। একই বিষয় নিয়ে তিনখানা পুঁথি ছাপা হয়েছে— (১) ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত কবি শ্যামদাস সেনের 'মীনচেতন' (১৯১৫), (২) মুন্সী আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত শেখ ফয়জুল্লার 'গোরক্ষবিজয়' (১৯১৭) ও (৩) ড. পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত ভীমসেনের গোর্থবিজয় (১৯৪১)।
কাহিনীর মূল রচয়িতা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। মূলত এসব বিষয়ে তখন আধুনিককালের মত সতর্ক বিশ্লেষণ প্রচলিত ছিল না। কাহিনী ছিল ধর্মীয় গানের অঙ্গ। সাধক ও ভক্ত বস্তুটির প্রতি যতটা অনুরক্ত ছিলেন, রচয়িতা নিয়ে ততটা মাথা ঘামাতেন না।
তাছাড়া এগুলোর অনেকটাই ছিল মৌখিক। তবে অনুমান করা হয় যে, শেখ ফয়জুল্লা এবং ভীমসেন ছড়া ও পাঁচালিগুলোকে মোটামুটি আখ্যানকাব্যে রূপ দিয়েছেন। কাহিনী ঃ একদিন শিব পার্বতীকে মহাজ্ঞান তত্ত্ব বুঝানোর সময় শিষ্য মীননাথ মাছের রূপ ধরে গোপনে তা শোনায় মীন অভিশপ্ত হন।
পার্বতী সবাইকে নিমন্ত্রণ করে অনু পরিবেশনকালে মীননাথসহ অন্যেরা পার্বতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে কামে উদ্দীপ্ত হল। গোরক্ষ কেবল পার্বতীকে মাতৃবৎ মনে করে। পার্বতী নগ্ন অবস্থায় শুয়ে থেকেও গোরক্ষকে পরীক্ষা করে। গোরক্ষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
শিবের নির্দেশে গোরক্ষ বিয়ে করে কিন্তু সে দাম্পত্য জীবন যাপন করে না। স্ত্রী ছেড়ে সন্ন্যাস জীবন বেছে নেয়। একদিন গোরক্ষ জানতে পায় যে, তার গুরু মীননাথ কদলী রাজ্যে নারীভোগে লিপ্ত, গোরক্ষ নারীদেরকে বাদুর করে উড়িয়ে দেয় এবং গুরুকে উদ্ধার করে।
দেহের উপর আত্মার জয় ঘোষণা নাথসাহিত্যের মূল উপজীব্য এখানে চিত্রিত হয়েছে। মূলত এ সাহিত্য নানা দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ। লোকসাহিত্য হিসেবে যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, মার্জিত সাহিত্য হিসেবে ততটা নয়।
ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের গান : বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে, বিশেষত উত্তরবঙ্গের কৃষক সমাজে রাজা গোপীচন্দ্র ও তার মাতা রানী ময়নামতী সম্বন্ধে অনেক অলৌকিক কাহিনী ছড়া পাঁচালি আকারে গীত হয়।
কোন কোন স্থানে লোকনাট্য হিসেবেও গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস বিষয়ক কাহিনী রয়েছে। বাংলাদেশে মৌখিক ছড়া পাঁচালি ছাড়াও এ কাহিনীর দু'একটি পুঁথিও পাওয়া গেছে। এ কাহিনীর বাস্তবসত্তা ও ঐতিহাসিকতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে সত্যাসত্য খুঁজে পান নি।
কাহিনী : রাজা গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রহণই এ পাঁচালির মূল বিষয়। রানী ময়নামতী অদ্ভুত শক্তি মহাজ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন। সেই জ্ঞানের প্রভাবে তিনি দেখলেন তার স্বামী মানিকচন্দ্রের শীঘ্র মৃত্যু হবে।
তাকে দীর্ঘায়ু দিতে রানী স্বামীকে মহাজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণে অনুরোধ করেন। কিন্তু পৌরুষে আঘাত লাগায় রাজা তা করলেন না। শীঘ্রই রাজার মৃত্যু হল। স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিন পর রানীর পুত্র সন্তান হল। নাম তার গোপীচন্দ্র গোপী বয়োপ্রাপ্ত হলে রানী তাকে অদুনা-পদুনা নামে দুই সহোদরা রাজকুমারীর সাথে বিয়ে দিলেন।
রানী মহাজ্ঞানে দেখলেন তার পুত্রেরও অকাল মৃত্যু হবে। হাড়িপার কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে কিছুদিন সন্ন্যাস গ্রহণ ছাড়া বাঁচার পথ নেই। পুত্র যুবতী স্ত্রীদের ফেলে যেতে চায় না, স্ত্রীরাও নারাজ। স্ত্রীদের প্ররোচনায় জলেশ্বরীপাকে জড়িয়ে প্রকাশ্যে মায়ের নামে অসতীত্বের অভিযোগ আনল।
ছেলের কাছে মাকে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হল। মায়ের নির্দেশমত হাড়িপার কাছে দীক্ষা নিতে হল। মাথা মুড়ে সন্ন্যাসী সাজতে হল। হাড়িপা তাকে হীরা নটীর বাড়িতে বাঁধা দিয়ে এলেন। অনেক কষ্টে গোপীর দিন কাটল, মেয়াদ শেষ হলে গুরু তাকে উদ্ধার করে মহাজ্ঞান দিলেন। তার আর অকাল মৃত্যু হল না।
পুঁথির নাম 'গোবিন্দচন্দ্রের গীত'। এতে দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস, শুকুর মাহমুদ প্রভৃতি কবিদের ভণিতা মেলে। এর ভাষা মার্জিত, বর্ণনার মধ্যেও গ্রন্থনৈপুণ্যের আভাস আছে।
কৃষক সমাজে কাহিনীটির প্রভাব ছিল। পরে হিন্দু-মুসলমান উভয় কবিরাই ঘষে-মেজে কাহিনীটাকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন।
আখ্যানকাব্যটির কাহিনী, চরিত্র ও বর্ণনা ঢঙে অশিক্ষিত মনের ছাপ পড়লেও ধর্মতত্ত্বাদি ব্যাখ্যায় কবিরা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। গোপীর মাতৃচরিত্রে সন্দেহ, বধূদের যড়যন্ত্র প্রভৃতি বিষয় বাস্তব সমাজেরই সাক্ষ্য দেয়।
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে গ্ৰীয়ার্সন সাহেব রংপুর থেকে স্থানীয় গায়কের নিকট সর্বপ্রথম গোপীচন্দ্রের গান সংগ্রহ করেন এবং 'মানিকচন্দ্র রাজার গান' নামে এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ১৯০৭-১৯০৮ সালে রংপুরের নীলফামারী মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট প্রাচীন সাহিত্যানুরাগী বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য তিনজন যোগীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ গান লিখে রাখেন।
১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোপীচন্দ্রের গানের ১ম খণ্ড এবং ১৯২৪ সালে ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয়। "বাংলা ১৩২১ সনে ঢাকা সাহিত্য পরিষদ থেকে ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী ও বৈকুণ্ঠনাথ দত্তের সম্পাদনায় 'ময়নামতীর গান' প্রকাশিত হয়। নেপালে প্রাপ্ত নেপালী গদ্যে রচিত 'গোপীচন্দ্র নাটক' এর মধ্যকার গানগুলো বিশুদ্ধ বাংলায় রচিত।
নাথধর্ম ও দর্শন সংক্রান্ত আখ্যানকাব্য ও ছড়া পাঁচালি ছাড়াও বিশুদ্ধ তত্ত্ব দর্শন সংক্রান্ত ছড়া পদও পাওয়া গেছে, যাতে কাহিনী নেই, আছে সাধন ভজনের গূঢ় ইঙ্গিতপূর্ণ পদ। এ রকম চারখানা পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেছে— যোগীর গান, যুগীকাচ, গোর্খ সংহিতা, যোগ চিন্তামণি নাথসাহিত্য বিষয়ক পুঁথিগুলোর ঐতিহাসিক ও সামাজিক মূল্য আছে।
কিন্তু সাহিত্য হিসেবে এর মূল্যমান তেমন না থাকলেও বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে নাথসাহিত্য এদেশের পাঠক-শ্রোতাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে।