ঠাকুরমার ঝুলি গল্পগুলোর মধ্যে রূপকথার বৈশিষ্ট্যের সার্থকতা বিচার কর
ঠাকুরমার ঝুলি গল্পগুলোর মধ্যে রূপকথার বৈশিষ্ট্যের সার্থকতা বিচার কর
ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলোর মধ্যে রূপকথার বৈশিষ্ট্যের সার্থকতা বিচার কর |
উত্তর : গল্প বলার বা শোনার অভ্যাস মানুষের একটি চিরন্তন অভ্যাস। মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তি আদিমকাল থেকেই চলে আসছে।
আদিমকাল থেকে শ্রুতিপরম্পরায় যে সকল বিষয়বস্তু চলে আসছে তাই গল্পের উপাদান। কোন কোন গল্প বা রূপকথা রোমান্সধর্মী কল্পনারাজ্যে স্বাধীন বিহার করে থাকে।
আমরা ছেলেবেলায় গ্রামের বুড়োবুড়ি বা দাদা- দাদি বা নানা-নানির মুখে কোনো ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যাকালে যেসব মনোহর ও চমকপ্রদ কাল্পনিক কাহিনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি সেগুলোই রূপকথা।
যেমন আলী বাবা চল্লিশ দস্যু আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ। রূপকথা আধুনিক গল্প উপন্যাস বা কথাসাহিত্যের আদিরূপ। দুটির উপাদান একই, পার্থক্য শুধু কাঠামোগত বা প্রকাশভঙ্গির। রূপকথা সম্পূর্ণ অবাস্তব কাল্পনিক বা স্বপ্নীল।
রূপকথা : রূপকথার সংজ্ঞা এক বাক্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ইংরেজি Marchen শব্দটির অনুবাদ হলো fairy বা household Tale' বাংলায় যাকে বলা হয় রূপকথা বা লোককাহিনি। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে বা শ্রুতিপরম্পরায় যেসব কাহিনি চলে আসছে তাই হলো রূপকথা।
কিন্তু আধুনিককালে রূপকথা বলতে শুধু সেই সব কাহিনিকেই বুঝায় যা গদ্যে বিধৃত। তবে তা লিখিত বা অলিখিত ঐতিহ্যের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে স্থানান্তরিত হয়ে এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে পৌঁছেছে।
অতএব আধুনিক সংজ্ঞানুযায়ী রূপকথা বলতে বুঝায় যা পুরুষ পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত সম্পদ এবং লিখিত বা মৌখিক গদ্যের বা পদ্যের ভাষায় প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
Fairy Tale বা Household Tale বলতে এমন বহুতর গল্পকে বুঝায় যে, প্রায় সব কাহিনিই এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। রূপকথার মধ্যে যে শুধু পরির গল্প থাকবে এমন কোন কথা নেই।স্টিয় থম্পসন লোককথা বা রূপকথার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে "Marchen হলো এক ধরনের কাহিনি যার নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য আছে আর আছে মটিফ বা অনুকাহিনির পরম্পরা।
এই কাহিনির ঘটনা ঘটে-অবাস্তব পৃথিবীতে যে পৃথিবীতে না আছে নির্দিষ্ট স্থান, না আছে নির্দিষ্ট চরিত্র, তদুপরি তা আশ্চর্য ব্যাপারে থাকবে পরিপূর্ণ। এই অসম্ভবের দুনিয়ায় নিরহঙ্কার নায়ক তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে বাদশাহি পায় আর রাজকুমারীদের বিয়ে করে।অতএব বলা যায়, রূপকথা হলো অবাস্তব পৃথিবীতে সংঘটিত সম্পূর্ণ অবাস্তব-কাল্পনিক বা স্বপ্নীল কাহিনি ।
রূপকথার বৈশিষ্ট্য : নিচে রূপকথার বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো
১. রূপকথায় কোন চরিত্রের নাম পাওয়া যায় না- কেবল রাজা, রাজপুত্র, রাজকন্যা, রানি ইত্যাদির পরিচয় পাওয়া যায়। রাজ্যের বা রাজার নাম পাওয়া যায় না কেবল এতটুকুই জানা যায়, এক দেশের এক রাজা বা একদেশের এক রাজপুত্র ছিল।
২. রূপকথার ঘটনা প্রবাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য কাহিনি হঠাৎ করে আরম্ভ হয় না এবং তার সমাপ্তও আকস্মিক ঘটে না। এর ভূমিকাঠি ধীরে সুস্থে আরম্ভ হয় এবং তা কাহিনির চূড়ান্ত পর্যায়ের পরও একটি স্থির বিন্দু পর্যন্ত অগ্রসর হয়। অর্থাৎ নানা রোমান্সকর ঘটনার ভেতর দিয়ে রূপকথার কাহিনি সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়।
৩. রূপকথায় যেসব নদ-নদী-পাহাড়-পর্বত, অরণ্য সমুদ্র অতিক্রম করে রাজপুত্র অগ্রসর হয়ে যায় সম্মুখের দিকে তারও কোন নাম পাওয়া যায় না। কেবল একটি মাঠ বা একটি ঘাটের নাম কখনো কখনো শুনতে পাওয়া যায়। যেমন তেপান্তরের মাঠ ও তিরপিনির ঘাট; কিন্তু সেটি কোথায় তার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
৪. রূপকথার মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক স্তরের সাংস্কৃতিক উপাদানের সমাবেশ লক্ষ করা যায়।
৫. রূপকথার মধ্যে একটা ঐন্দ্রজালিক প্রভাব বিদ্যমান থাকে।
৬. রূপকথায় কোন বিশেষ চরিত্র নয়, বরং প্রত্যেকটি চরিত্রই টাইপ চরিত্র। প্রতিটি টাইপ চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানুষের বিভিন্ন ধরনের মানবিক আকাঙ্ক্ষা এবং চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে।
৭. রূপকথার গল্পগুলো উপদেশমূলক নয়। উপদেশ থাকলেও তা ছদ্মবেশে প্রকাশ করা হয়েছে।
৮. রূপকথা কালের সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়।
৯. রূপকথার মধ্যে সত্যের জয় এবং মিথ্যার পরাজয় পরিলক্ষিত হয়।
১০. রূপকথার একটি গল্পের সাথে অন্য গল্পের কাঠামোগত মিল রয়েছে।
১১. রূপকথার শেষ পরিণতি সব সময় মিলনাত্মক হয়।
১২. মানুষের বাস্তব জীবনে যা পাওয়া সম্ভব নয় তার আকাঙ্ক্ষাই রূপকথার মধ্যে প্রকাশ পায়।
তাই রূপকথা কল্পনাশ্রয়ী।উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যের আলোকে এবার আমরা বিচার করে দেখবো “ঠাকুরমার ঝুলি” রূপকথা হিসেবে কতটুকু সার্থক।রূপকথার গল্পে কোন চরিত্রের নাম, কোন রাজার, কোন রাজপুত্রের, কোন রানি বা কোন রাজ্যের নাম পরিচয় পাওয়া যায় না।
এই বৈশিষ্ট্য ঠাকুরমার ঝুলির অনেক গল্পের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। যেমন: কলাবতী রাজকন্যা গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে 'এক যে রাজা। রাজার সাত রানি। 'ঘুমন্তপুরী' গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে- 'এক দেশের এক রাজপুত্র।নানা রোমান্সকর ঘটনার মধ্য দিয়ে কাহিনি অগ্রসর হবে।
“ঠাকুরমার ঝুলি”র অন্তর্গত 'ঘুমন্তপুরী", "কিরণমালা', 'সাত ভাই চম্পা' প্রভৃতি গল্পে অত্যন্ত রোমান্সকর অবিশ্বাস্য অসম্ভব ঘটনার মধ্য দিয়ে কাহিনি অগ্রসর হয়েছে এসব গল্পে।রূপকথার রাজপুত্র যেসব নদী-পাহাড়, পর্বত, অরণ্য, প্রান্তর অতিক্রম করে অগ্রসর হয় তার কোন নাম পাওয়া যায়। না।
এগুলো সাত সমুদ্র তেরো নদী পার বলে উল্লেখ আছে। 'ঠাকুরমার ঝুলি'র “নীল কমল আর লালকমল” গল্পে নায়ক বেঙ্গমা বেগমীর পিঠে চড়ে ডাঙ্গা, জঙ্গাল, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত-মেঘ আকাশ চন্দ্র, সূর্য অতিক্রম করে সেই রহস্যময় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার রাক্ষসদের রাজ্যে গিয়ে পৌঁছায়।
এছাড়া অন্যান্য গল্পগুলোর মধ্যেও এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।রূপকথাগুলোর মধ্যে ঐন্দ্রজালিক প্রভাবের বিস্তার দেখতে পাওয়া যায়। আর এই বৈশিষ্ট্যটি “ঠাকুরমার ঝুলি”র প্রায় সবগুলো গল্পের মধ্যেই কমবেশি দেখতে পাওয়া যায়।
কাঁকনমালা কাঞ্চনমালা' গল্পে দেখা যায় বন্ধুর সাথে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের কারণে তার (রাজপুত্রের) সারা শরীরে সুচ গজিয়ে উঠে। 'কিরণমালা' গল্পে পিছনের দিকে ফিরে তাকানোর জন্য পাথর হয়েছে রাজপুত্ররা।
‘কলাবতী রাজকন্যা' গল্পে সন্ন্যাসীর ওষুধ খেয়ে সব রানিরা সন্তান কামনা করেন-রানি।রূপকথার গল্পে সব সময় সত্যের জয়, মিথ্যার পরাজয় পরিলক্ষিত হয়। 'ঠাকুরমার ঝুলি'র প্রায় সব গল্পেই এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়।
সাত ভাই চম্পা, 'শীত বসন্ত', 'কিরণমালা' প্রভৃতি গল্পে সত্যের জয় এবং মিথ্যার পরাজয় চমৎকারভাবে পরিলক্ষিত হয়। সত্যের প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধা তা রূপকথার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন গল্পে।রূপকথার গল্পের কাঠামো রূপকথার গল্পের চরিত্রগুলো Type চরিত্র হয়।
'ঠাকুরমার ঝুলি'র বিভিন্ন গল্পের চরিত্রগুলোও Type চরিত্র। তাদের চরিত্রে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়নি। রাজপুত্ররা সাধারণত সাহসী, বুদ্ধিমান, তেজস্বী, বিদ্রোহী এবং যোদ্ধা থাকে। 'ঠাকুরমার ঝুলি'র বিভিন্ন গল্পের যেমন 'কলাবতী রাজকন্যা', 'শীত বসন্ত', ‘কাঁকনমালা কাঞ্চনমালা' প্রভৃতি গল্পে রাজপুত্ররা অসীম সাহস দেখিয়েছে।রূপকথার একটি গল্পের সাথে অন্য গল্পের কাঠামোগত মিল রয়েছে।
'ঠাকুরমার ঝুলি'র অন্তর্গত বিভিন্ন গল্পেও কাঠামোগত মিল দেখতে পাওয়া যায়। ‘শীতবসন্ত', 'সাত ভাই চম্পা', 'কলাবতী রাজকন্যা' প্রভৃতি গল্পে বিমাতাদের হিংসা এবং তাদের পতনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। হিংসা কোনদিনই পুরষ্কৃত হয় না।
এই কথাটিই বুঝানো হয়েছে তিনটি গল্পের মাধ্যমে।রূপকথার গল্পগুলো কোন নির্দিষ্ট কালের পরিসীমায় আবদ্ধ নয়। 'ঠাকুরমার ঝুলি'র গল্পগুলোও কোন নির্দিষ্ট কাল সীমায় আবদ্ধ নয়। এর অন্তর্গত গল্পগুলোতে কোন নির্দিষ্ট যুগের ঘটনা চরিত্র বা সংস্কার বিধৃত হয়নি।
তাই এগুলোর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।রূপকথার গল্পের শেষে মিলনাত্মক পরিণতি পরিলক্ষিত হয়। 'ঠাকুরমার ঝুলি'র বিভিন্ন গল্পে নানা রকম ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ-আপদের পরে মিলন দেখানো হয়েছে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের 'ঠাকুরমার ঝুলি' গ্রন্থে রূপকথার বৈশিষ্ট্যগুলো যথোপযুক্তভাবে প্রয়োগ হয়েছে। তাই রূপকথা হিসেবে গল্পগুলো সার্থকতা লাভ করেছে। 'ঠাকুরমার ঝুলি'র গল্পগুলো তাই- বাংলার সমস্তমানুষের হৃদয়গত আবেদন লাভ করেছে।