মহুয়ার পরিচয় দাও
মহুয়ার পরিচয় দাও
মহুয়ার পরিচয় দাও |
অথবা, মহুয়ার শেষ পরিণতি সংক্ষেপে লিখ ।
উত্তর : মনসুর বয়াতি রচিত, দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত “মৈমনসিংহ গীতিকার" অন্তর্গত 'মহুয়া' পালাতে নায়িকা চরিত্র মহুয়া। মহুয়া হুমরা বেদের পালিত কন্যা। হুমরা বেদে একদিন ধনু নদীর পাড়ে কাঞ্চনপুর গ্রাম থেকে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছ'মাসের কন্যাকে চুরি করে এবং তাকে নিজের সন্তানের মতো করে বড় করে তোলে। মহুয়া রূপে গুণে ছিল সুন্দরী এক নারী। তার রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে পালাকার বলেছেন-
“সাপের-মাথায়-যেমন থাইক্যা-জ্বলে-মণি ।
যে-দেখে-পাগল-হয়-বাইদ্যার-নন্দিনী ॥
বাইদ্যা বাইদ্যা করে লোকে বাইদ্যা কেমন জনা।
আন্দাইর ঘরে ধুইলে কন্যা জ্বলে কাঞ্চা সোনা "
হুমরা বেদে মহুয়াকে ছোটবেলা থেকেই খেলা, নাচ, গানে পারদর্শী করে তোলে। একদিন হুমরা বেদে তার কন্যাকে এবং দলবল নিয়ে বামনকান্দা গ্রামের জমিদার নদ্যার চানের বাড়িতে খেলা দেখাতে যায়
সেখানে নদের চাঁদ মহুয়ার রূপ ও গুণ দেখে প্রেমে পড়ে যায়। মহুয়া একসময় নদের চাঁদকে ভালোবাসে। তাদের এই ভালোবাসার কথা জানতে পেরে তার পিতা বামনকান্দা গ্রাম ত্যাগ করে। নদের চাঁদ একসময় খুঁজতে খুঁজতে মহুয়াকে পেয়ে যায়।
তখন হুমরা বেদে মহুয়াকে বলে নদের চাঁদকে হত্যা করতে। মহুয়া তা না করে নিজের প্রেমকে বাঁচানোর জন্য নদের চাঁদের সাথে পালিয়ে যায়। নদের চাঁদ ও মহুয়া নদী পার হতে গিয়ে সাধু তার প্রেমে পড়ে তাই সে ষড়যন্ত্র করে নদের চাঁদক ডুবিয়ে দেয়।
তারপর সাধু মহুয়াকে বিভিন্ন জিনিসের লোভ দেখালেও মহুয়া তাতে রাজি হয়নি। সে কৌশলে পানের সাথে বিষ মিশিয়ে নৌকার সবাইকে অচেতন করে পালিয়ে আসে।
এরপর মহুয়া নদের চাঁদকে খুঁজে পায়। সেখানে এক সন্ন্যাসী মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়। মহুয়া বুদ্ধি করে সন্ন্যাসীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে। পরবর্তীতে নদের চাঁদ ও মহুয়া বনের ভিতর একসাথে
জীবনযাপন করতে থাকে। কিন্তু হুমরা বেদে তাদের বন্দি করে। বন্দি করে হুমরা মহুয়ার হাতে বিষলক্ষের চুরি তুলে দেয় নদের চাঁদকে হত্যা করে সুজনকে বিয়ে করার জন্য।
কিন্তু মহুয়া তা না করে সেই ছুরি দিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। এখানে নিজের জীবনের চেয়ে প্রেমকে বড় করে দেখে মহুয়া। গীতিকার ভাষায়-
“শুন-শুন প্রাণপতি বলি যে-তোমারে।
জন্মের-মতন বিদায়-দেও-এই-মহুয়ারে
শুন শুন পালং সই শুন বলি কথা।
কিঞ্চিৎ বুঝিবে তুমি আমার মনের বেথা ॥”
গাথার কেন্দ্রীয় চরিত্র মহুয়ার মধ্যে সাহসিকতার ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তার সতীত্ব ব্যক্তিত্বের দ্যোতক। প্রণয়াকাঙ্ক্ষায় সে যেমন একনিষ্ঠ- তেমনি প্রণয়াকাঙ্ক্ষীর প্রতিও সে বিশ্বস্ত।
হুমরা বেদের নিষ্ঠুর নির্দেশে মহুয়া নদের চাঁদকে হত্যা না-করে ছুরিকাঘাতে আত্মহত্যা বা আত্মবিসর্জনের যে সাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা ব্যতিক্রমধর্মী প্রেম সাধনায় অত্যুজ্জ্বল। প্রেমের মর্মার্থ উপলব্ধি করে মহুয়া আত্মবিসর্জনের পথে পা বাড়িয়েছে।
নদের চাঁদহীন জীবন তার কাছে অসহনীয় তাই মৃত্যুর হাত ধরে প্রেমিকের সহযাত্রী হয়ে অভিসারে যাত্রা করেছে। বরং মিলনে নয় মৃত্যুতেই তার হেম আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।