দেওয়ানা মদিনা' পালার নাট্যগুণ আলোচনা কর

দেওয়ানা মদিনা' পালার নাট্যগুণ আলোচনা কর

দেওয়ানা মদিনা' পালার নাট্যগুণ আলোচনা কর
দেওয়ানা মদিনা' পালার নাট্যগুণ আলোচনা কর

উত্তর : মানবিক আবেদন, সত্যভাষণ, প্রণয়ের অমর মহিমা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, অপূর্ব সৌন্দর্য ও কাব্যমূল্য প্রভৃতি দিক থেকে মৈমনসিংহের গীতিকাগুলো বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সংযোজন। 

সামন্তরূপ এক স্থবির, অচঞ্চল ও গতিহীন সমাজ কাঠামোর সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আবর্তিত এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা- বেদনাহ্ বাস্তবতা ও মনন-মুক্তির প্রবল আকাঙ্ক্ষায় গীতিকাগুলোতে পরম আন্তরিকভাবে বিধৃত হয়েছে। 

উত্তরে পাহাড় শ্রেণি, বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হাওড়, পাহাড়ের দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকা বেয়ে প্রবাহিত ছোট ছোট নদী প্রভৃতি বিশেষ ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে গীতিকাগুলোর উদ্ভব, পরিপুষ্ট ও বিকাশ। বিষয়বস্তু ও ভাবগত উভয়দিক থেকে “মৈমনসিংহের গীতিকা"-গুলো বাংলা সাহিত্যের এক ঐশ্বর্যময় সম্পদ।

নাট্যধর্মিতা : গীতিকা নাট্যধর্মী হয়ে থাকে অর্থাৎ এর মধ্যে সংলাপ নাটকীয়তা ও গতিময়তা থাকবে। 'দেওয়ানা মদিনা'রও বেশকিছু অংশ সংলাপে রচিত। এর মধ্য দিয়ে কাহিনি নাটকীয়তা লাভ করেছে ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সৎ মায়ের প্ররোচনায় জন্মান যখন আলাল-দুলালকে হত্যা করতে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই গীতিকাতে এসেছে নাটকীয়তা। যেমন জন্মান ও আলাল দুলালের কথোপকথন-

জল্লাদের উক্তি :

                             “ইয়াদ কর- আল্লার নাম মরণকালের আগে।"

                                            তোমরার যম আমি দুয়ারেতে খাড়া। 

                              আমার হাতেতে দুইজন যাইবা যে মারা !"

                                           “আলাল কান্দিয়া কয় জন্মাদের পায় ধরি। 

                         “আমারে মারিয়া দেও দুলালেরে ছাড়ি” ।

                                            দুলাল কয় "শুন জন্মাদ, রাখ মোর কথা। 

                        ভাইয়েরে না রাখ্যা আমারে মার দিয়া বেথা

আলাল তার কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে সেকেন্দার দেওয়ানের সাহায্যে যখন তাদের পুরাতন দেওয়ানি ফিরে পেয়েছে তখনও গীতিকাতে এসেছে নাটকীয়তা। গানের সূত্র ধরে আলাল তার ছোট ভাই দুলালকে খুঁজে পায়। যেমন—

আলাল দুলালের উক্তি :

                                   "পরে মিল্যা সগলে গান জুড়িল।

                                            এক দেওয়ানের দেখ দুই বেটা ছিল 

                                                         দুই বেটা রাখ্যা বিবি যায় মরিয়া । 

                                                                     বিবি মরিলে সাদি করল সেই মিঞা

                                                                              সেই না দুষ্ট বিবি আরে কোন কাম করে। 

                                                                                      বাইল দিয়া জলে পাঠায় দেওয়ানের দুই বেটারে।

গীতিকা পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে অনেক কিছুই অনুপস্থিত- ধরে নেওয়া হয় সেগুলো অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো। দুলাল তার ভাই আলালের প্রস্তাবে মদিনাকে তালাক নিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে তার নিজেদের বানিয়াচঙ্গ অঞ্চলে ফিরে আসে- 

এ ফিরে আসার মধ্যে নাটকীয়তা ভরপুর। আলাল-দুলালের সাথে সেকেন্দার দেওয়ানের দুই মেয়ের সাদি হয়েছে দ্রুত এবং নাটকীয় কায়দায়। এই বিয়ের কোনো বর্ণনা নেই শুধু বিয়ের সংবাদটিই পাঠককে গোচরীভূত করা হয়েছে। যেমন--

                                      "মমিনারে আলাল আর দুলাল আমিনারে।

                                               সৱা মতে বিয়া কইরা আইল নিজ ঘরে ।"

মদিনার কথামতো তার ভাই এবং তার ছেলে সুরুজ দুলালের খোঁজ করলে দুলাল তাদেরকে প্রত্যাখ্যান এবং একই সাথে তিরস্কার করে । কিন্তু সে আর মদিনার কাছে ফিরে আসে না। অথচ মদিনার মৃত্যুর পরে সে আবার নাটকীয় কায়দায় ফিরে আসে মদিনার কাছে। পালাকারের ভাষায়:

                   “কয়বর দেখাইয়া পরে জমিনে পড়িয়া।

                          কান্দিতে লাগিল পুত্র মায়ের লাগিয়া

                                     দুলাল পড়িয়া কান্দে কয়বর উপরে।

                                              “হায় গো আল্লাজী পড়লাম কি পাপের ফেরে 1

                                                        নিজ হাতে বধ করলাম জননার পরাণ।

                                                                      এই দুনিয়াতে মোর আর নাই থান "

সুতরাং সার্বিক আলোচনা থেকে বলা যায়, গীতিকার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা- এই নাটকীয়তার বিভিন্ন উপাদানের সমাবেশ ঘটেছে 'দেওয়ানা মদিনা' পালায়। সৎ মায়ের হাত ধরে নাটকীয়তার যাত্রা এবং সে যাত্রার অবসান ঘটেছে মদিনার মৃত্যুতে ও মদিনার কবরের কাছে দুলাল চিরতরে আগমনের মধ্য দিয়ে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ