ব্রিটিশ রাজনীতি সম্বন্ধে সংক্ষেপে বর্ণনা কর
ব্রিটিশ রাজনীতি সম্বন্ধে সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
ব্রিটিশ রাজনীতি সম্বন্ধে সংক্ষেপে বর্ণনা কর। |
উত্তর : রবীন্দ্রনাথ যখন ইউরোপে যান প্রথমবারের মতো তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের একশ বছর পেরিয়ে গেছে। উপনিবেশিত রাষ্ট্রের সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেছেন ঔপনিবেশিক প্রভুর দেশে। যাওয়ার পূর্ব থেকেই ব্রিটিশ সমাজ সম্পর্কে একটি ধারণা নিয়ে গেছেন। ব্রিটিশদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল আকাশচুম্বী।
দ্বিতীয় পত্রে তিনি বলেছেন : “ইংল্যান্ডে আসবার আগে আমি নির্বোধের মতো আশা করেছিলেম যে, এই ক্ষুদ্র-দ্বীপের দুই হস্ত-পরিমিত ভূমির সর্বত্রই গ্ল্যাডস্টোনের বাগ্মিতা, ম্যাকসমূলারের বেদব্যাখ্যা, টিভ্যালের বিজ্ঞানতত্ত্ব, কার্লাইলের গভীর চিন্তা, বেনের দর্শনশাস্ত্রে মুখরিত। সৌভাগ্যক্রমে তাতে আমি নিরাশ হয়েছি।”
সুতরাং ভ্রমণ শুরুর আগে ব্রিটিশদের সম্পর্কে লেখকের অতি উচ্চ ধারণা ছিল। কিন্তু লেখকের এ ধারণা এখানে এসে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে রবীন্দ্রনাথ দেশে থাকা কালে তাঁর জন্মের পূর্বেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় বাঙালি সমাজে যে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ হয়েছিল মনে করা হয় তার পেছনে প্রেরণা ছিল ব্রিটিশ শাসন।
কিন্তু ব্রিটেনে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে সেখানের নারীরা চটুল বিলাসিতায় লিপ্ত আর সাধারণ পুরুষেরা সকলে জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত নয়। ব্রিটিশদের রাজনীতি চর্চার একটি আদর্শ কেন্দ্র হাউস অব কমন্স। সেখানকার রাজনীতি বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রকাশ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। একাধিকবার তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কার্যক্রম দেখেছেন।
তাঁর সে অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে চতুর্থ পত্রে। গ্ল্যাডস্টোনের বাগ্মিতায় তিনি মুগ্ধ হয়ে বলেছেন :“গ্ল্যাডস্টোন অনর্গল বলেন বটে কিন্তু তার প্রতি কথা ওজন করা, তার কোন অংশ অসম্পূর্ণ নয়; তিনি বক্তৃতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্বরে জোর দিয়ে বললে না, কেননা সে-রকম বলপূর্বক বললে স্বভাবতই শ্রোতাদের মন তার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়ায় ।
তিনি যে কথায় জোর দেয়া আবশ্যক মনে করেন, সে কথাতেই জোর দেন, তিনি খুব তেজের সঙ্গে বলেন বটে কিন্তু চিৎকার করে বলেন না, মনে হয় যা বলছেন, তাতে তাঁর নিজের খুব আন্তরিক বিশ্বাস।”
ষাট বছরের রাজনৈতিক জীবনে গ্ল্যাডস্টোন চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রবীণ প্রধানমন্ত্রী। গোটা উনিশ শতকে ব্রিটিশ রাজনীতির অনেক সংস্কার ও উন্নয়নে তাঁর অবদান ছিল ব্যাপক।
হাউস অব কমন্সে রবীন্দ্রনাথ সদস্যদের আচরণ দেখে অবাক হয়েছেন। তিনি বলছেন, “আমাদের দেশে সভাস্থলে ইস্কুলের ছোকরাও হয়ত এমন করে না।” প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, সুপ্রাচীনকাল থেকে আয়ারল্যান্ড-ব্রিটেন পরস্পর বৈরী।
১৭৯৮ সালে আইরিশ বিপ্লবের পর ব্রিটিশরা ১৮০১ সাল থেকে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ইউনিয়ন গঠন করে। অ্যাক্ট অব ইউনিয়ন ১৯১২ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। যদিও এ অ্যাক্টে আইরিশরা যথাযথ মর্যাদা পায় নি। ফলে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ হয়। ১৮২৩ সালে ড্যানিয়েল ও'কোনেল নামের একজন আইরিশের নেতৃত্বে সফল আন্দোলনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আসন পাওয়ার অধিকার অর্জন করে আইরিশরা।
১৮৭০ এর দশকে আইরিশ পার্লামেন্টারি দলের সদস্য চার্লস স্টুয়ার্ট পারনেলের নেতৃত্বে আইরিশদের নিজস্ব সরকারের বিতর্ক জেগে উঠে। পারনেলের রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যায় নারী ঘটিত স্ক্যান্ডালে জড়িত হওয়ার কারণে।
আইরিশ সদস্যদের তোলা প্রশ্নের বিষয়বস্তুতে সে সময়ের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নিষ্ঠুরতার ছবি ধরা পড়েছে। খবরের কাগজে জুলুদের প্রতি ইংরেজ সৈন্যদের অত্যাচারের যে বিবরণ বেরিয়েছে তা নিয়ে পার্লামেন্টে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আলোচনা থেকে বুঝা যায়, আলোচনা ও বাদানুবাদে ব্রিটিশরা একপক্ষ ও আইরিশরা অন্যপক্ষ অবলম্বন করে ।
সরকারি দল ও বিরোধী দলের সরগরম কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মুখরিত থাকে। সেখানের রাজনীতিতে পরমত সহিষ্ণুতা থাকায় ভারতবর্ষের মতো অস্থির হয়ে উঠে না। সব মিলিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতির একটি চিত্র আমরা রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ প্রবাসীর পত্রে'র মাধ্যমে পেয়ে থাকি।