মঙ্গলকাব্য প্রধানত কত প্রকার ও কি কি
মঙ্গলকাব্য প্রধানত কত প্রকার ও কি কি
মঙ্গলকাব্য প্রধানত কত প্রকার ও কি কি |
উত্তর : মধ্যযুগে অসংখ্য দেব-দেবীকে ঘিরে অসংখ্য মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল। এসব মঙ্গলকাব্যকে প্রধানত তিনটি সমৃদ্ধ শাখায় বিভক্ত করা যায়—
ক. চণ্ডীমঙ্গল,
খ. মনসামঙ্গল,
গ. ধর্মমঙ্গল।
এছাড়া অন্নদামঙ্গল, শিবমঙ্গল, দুর্গামঙ্গল, কালিকামঙ্গল কাব্যেরও বেশ প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
ক. চণ্ডীমঙ্গল: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের ধারায় চণ্ডীমঙ্গল কাব্য এদেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং কয়েকজন শিল্পীর দ্বারা কাব্যধারায় রূপায়িত হয়েছে। চণ্ডীদেবীর পূজা প্রচারে এ কাব্য লিখিত হলেও সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র ও সমাজচিত্র এ কাব্যে স্থান পেয়েছে।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি মানিক দত্ত এবং শ্রেষ্ঠকবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ধনপতি সদাগরের উপাখ্যান এবং কালকেতুর উপাখ্যান নামে দুটি কাহিনী স্থান পেয়েছে।
খ. মনসামঙ্গল কাব্য ঃ অনার্য সমাজ থেকে স্ত্রী দেবতার পূজার প্রচলন আর্য সমাজে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে এবং দাক্ষিণাত্যে মনসা খুবই জনপ্রিয় ছিল। মনসামঙ্গল কাব্য মূলত পূর্ব বাংলার দান।
নদী ও বনজঙ্গল প্রধান পূর্ব বাংলায় বরাবরই সাপের প্রকোপ বেশি । সাপের হাত থেকে রক্ষা পেতে এ বাংলার মানুষেরা মনসা পূজা করে। মনসামঙ্গল প্রধানত দেব ও মানবের সংগ্রামের কাহিনী ।
গ. ধর্মমঙ্গল: ডোম জাতীয় লোকেরা ধর্মঠাকুরের নামে একখণ্ড পাথরকে পূজা করে। এ কাব্যেরও দুটো কাহিনী আছে- হরিশচন্দ্র রাজার কাহিনী ও লাউসেনের কাহিনী ।
শীতলামঙ্গল : চিকিৎসাশাস্ত্রের অনগ্রসরতার কারণে বসন্ত রোগের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য শীতলা দেবীর পূজা করা হয়। সে উদ্দেশ্যে রচিত শীতলামঙ্গল কাব্য। কৃষ্ণরাম দাসের শীতলামঙ্গল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
দুর্গামঙ্গল কাব্য: চণ্ডী দেবীর অপর নাম দুর্গা। দুর্গার মহিমা কীর্তনের উদ্দেশ্যে রচিত কাব্য দুর্গামঙ্গল কাব্য । দ্বিজ কমললোচন ও ভবানী প্রসাদ রায় দুর্গামঙ্গল কাব্যের প্রধান কবি ।
রায়মঙ্গল : রায়মঙ্গল কাব্যটি অনার্য যুগের ধর্ম বিশ্বাস ও লোককাহিনী আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। দক্ষিণা রায়ের মহিমা কীর্তনই কাব্যের প্রধান বিষয়। কৃষ্ণরাম দাস, রুদ্রদেব ও হরিদেব রায়মঙ্গল কাব্যের বিশেষ কবি ।
কালিকামঙ্গল : কালিকা দেবীর মহিমা কীর্তনই কালিকামঙ্গল কাব্য। কিন্তু মূলত বিদ্যা ও সুন্দরের অবৈধ প্রেমের বর্ণনা তথা রোমান্টিক কাহিনী এ কাব্যে প্রধান। এ কাব্যের কবিরা হলেন— দ্বিজ, শ্রীধর, সাবিরিদ খাঁ, কৃষ্ণরাম দাস, বলরাম চক্রবর্তী প্রমুখ ।
অন্নদামঙ্গল : চির দারিদ্র্যের দেশ বাংলাদেশ। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয় বার বার। অন্নদাত্রী দেবীকে তাই বিশেষ মর্যাদায় পূজা করার রীতির মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে অন্নদামঙ্গল কাব্য। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এ কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ।
মঙ্গলকাব গুলো দেবদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও এতে বাঙালি জীবনের ইতিহাস প্রতিফলিত হয়েছে। মধ্যযুগের বাংলার জীবন ইতিহাসের বহু অপ্রাপ্ত তথ্যের শূন্যস্থান পূর্ণ করেছে মঙ্গলকাব্য।
এ কাব্য থেকে বাঙালির জাতীয় জীবনের একটি নিত্যকালের চিত্রের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। বাঁধাধরা কাহিনীর মধ্যে বাস্তব জীবনচিত্র অঙ্কনে কবিদের বিশেষ কৃতিত্বে মঙ্গলকাব্যধারা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে উজ্জ্বল করেছে ।