বিদ্যাসুন্দর কাব্যের পরিচয় দাও

বিদ্যাসুন্দর কাব্যের পরিচয় দাও

বিদ্যাসুন্দর কাব্যের পরিচয় দাও
বিদ্যাসুন্দর কাব্যের পরিচয় দাও

উত্তর: শাহ বারিদ খানের 'বিদ্যাসুন্দর' নিছক মানবীয় প্রেমের কাহিনী। লৌকিক মানসভূমি থেকে এটি উদ্ভূত হয় নি, শিক্ষিত কবিচিন্তার ফসল এটি। বাংলাদেশে হিন্দুর মানসিকতায় কাহিনীটি কালিকামঙ্গলে বা অন্নদামঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মানবিক রসকাব্যের মর্যাদা হারিয়েছে। রত্নাবতীর রাজা গুণসার সুখে প্রজাপালন, পূজাকর্ম ও দানধ্যান করেন। রানী কলাবতী ধর্মপ্রাণা ও পতিব্রতা নারী। 

তাঁদের দুঃখ, কোন সন্তানসন্ততি নেই। বিষবৎ ভবসুখ ভাবে নরপতি। বিষাদে বিকল পুত্রকন্যা হেতু নিতি। কলাবতী রাজাকে যাজ্ঞযজ্ঞ ও ধর্মকর্ম করতে বললেন । রাজা তাই করলেন। 

দেবী পার্বতী কলাবতীকে পুত্রসন্তানের বর দিলেন। কলাবতী গর্ভবতী হলেন এবং যথাসময়ে পুত্রসন্তান লাভ করলেন। সন্তানের নাম রাখা হল সুন্দর। ছেলেবেলা থেকে রাজা সুন্দরের উত্তম লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলেন। দেবীর আশীর্বাদে সুন্দর বার বছরে সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠল। 

নানা দেশের পণ্ডিতের সাথে তর্কযুদ্ধে সুন্দরই জয়পত্র লাভ করল। বিদ্যাজয়ী সুন্দরের নাম হল 'বিদ্যাপতি'। এরপর সে মহেশ অম্বিক সেবা করএ সতত। মহাকাব্যে বিরচিল শ্লোক পঞ্চাশত । কাঞ্জিপুরের রাজা বীর সিংহ ও রানী শীলার একমাত্র কন্যা বিদ্যাপতি। 

পাঁচ বছর বয়স থেকে তার হাতে খড়ি হল এবং সে অল্পকালেই পাণ্ডিত্য অর্জন করল। রাজকন্যা স্বয়ং বরের ব্যবস্থা করলেন। বিদ্যা বলল প্রতিজ্ঞা মোহর হৃদে। যে জিন এ শাস্ত্রবাদে/সেই যোগ্য পতিক ভজিমু। রাজা কন্যার প্রতিজ্ঞা শুনে দিকে দিকে ভাট পাঠালেন। 

মাধবভাট রত্নাবতীতে এসে সুন্দরকে বিদ্যার রূপ ও পাণ্ডিত্যের কথা বলল । সুন্দর বিদ্যাকে পাওয়ার জন্য ‘কক্ষে দুই পুথি/কান্ধে লই ছাতি/ধরিয়া বৈদেহী বেশ। বিদ্যা অন্বেষণ/করিলা গমন/ নগরে কৈলা পরবেশ।— এখানে এক মালিনীর গৃহে সে আশ্রয় নিল। মালিনী বিদ্যাকে মালা জোগায় । 

মালিনী প্রথমে রাজভয়ে আশ্রয় দিতে নারাজ হয়, কিন্তু সুন্দর তাকে অর্থে বশীভূত করে। মালিনীর কাছে সুন্দর বিদ্যার তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করে। মালিনী বলল, নানা শাস্ত্ৰ কাব্য ও অলঙ্কার গ্রন্থ পাঠ করে বিদ্যা জ্ঞান অর্জন করেছে। 

কবি স্বয়ং বিদ্যাসুন্দর কাব্যকে নাটগীতি বলেছেন। তাতে রয়েছে অভিনয় ধর্ম সংলাপ এবং ক্রিয়া দ্বারা তা প্রকটিত। শাহ বারিদ খানের কাব্যে মঞ্চ নির্দেশ পর্যন্ত আছে। কবি প্রতিটি ঘটনার সূচনায় সংস্কৃতে দৃশ্য সংকেত ও রূপসজ্জার বর্ণনা দিয়েছেন। কাব্যে উক্তি প্রত্যুক্তি আছে । 

সুন্দর মাধবভাট ও সুন্দর মালিনীর সংলাপ বেশ উজ্জ্বল । সুন্দর-মালিনীর নাতিদীর্ঘ সংহত সংলাপ নাটকোচিত হয়েছে। সংলাপের সংগীত ধর্ম সম্বন্ধে শাহ বারিদ খানের জ্ঞান ছিল । তাঁর কয়েক স্থলে রাগ ও ছন্দের উল্লেখ করেছেন। 

মালিনী সুন্দরের আলাপের অংশটি দেশাগ রাগে রচিত হয়েছে। ‘সুন্দরের কাঞ্চিপুর যাত্রা অংশ, পাঞ্চালি ছন্দে রচিত। নাট্যিক ও সাংগীতিক সংলাপ থাকা সত্ত্বেও বিবৃতিধর্মী আখ্যানকাব্যের স্বাদ নষ্ট হয় নি। কবি নাট্যকাব্য রচনা করেছেন, নাটক রচনা করেন নি। কাব্যের শুরুতে আখ্যানের মত বর্ণনা আছে। 

সংলাপের মাঝে মাঝে কবি নিজের কথা দিয়ে ঘটনাকে প্রসৃত করেছেন । শাহ বারিদ খান সংস্কৃত ভাষার কোন এক কাব্যকে প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ করে ‘বিদ্যাসুন্দর' কাব্য রচনা করেছেন বলে গবেষকদের মত। 

তাঁর ভাষা সংস্কৃতানুগ, বিশুদ্ধ এবং পরিমার্জিত স্থান বিশেষ ভাষার আবেগ আছে, কিন্তু গতি ও ব্যঞ্জনা তেমন নেই। খণ্ডিত পুথি দিয়ে কবির প্রতিভার পূর্ণ পরিচয় নির্ণয় করা যায় না, প্রাপ্ত অংশের নিদর্শন বিচার করে বলা যায়, শাহ বারিদ খানের কবিত্বে কষ্ট কল্পনা বা কৃত্রিমতা ছিল না।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ