ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন আলোচনা কর
ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন আলোচনা কর
অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্ম বিকাশের একটি সুদীর্ঘ ক্রমবিবর্তনের ধারা রয়েছে। দানশীলতা ও বদান্যতানির্ভর সমাজসেবা সুপ্রাচীনকাল থেকেই এখানে সমুজ্জ্বল। সমাজজীবনের পরিবর্তিত পরিস্থিতি, অনুভূত চাহিদা ও প্রয়োজন মোকাবিলার প্রশ্নে ধর্মীয় ও নৈতিকতাভিত্তিক সমাজকল্যাণ বিবর্তনের ধারা অতিক্রম করে পেশাগত মর্যাদা অর্জন করে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, উদ্যোগ এবং বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন আলোচনা কর |
● ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন : নিম্নে ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন আলোচনা করা হলো-
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ভারতীয় উপমহাদেশে সৃষ্ট জটিল আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান মিশনারিরা সমাজসেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভারতবর্ষে আসেন। তারা বোম্বেসহ বেশকিছু এলাকার বস্তিবাসীর উন্নয়নের জন্য কাজ করেন । যাকে পেশাদার সামাজকর্মের সূচনাকাল বলা যেতে পারে।
২. ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ডের উদ্যোগ : ভারতে পেশাদার সমাজকর্মের অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা রাখেন ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ড। তিনি বোম্বের বস্তিবাসীদের সমস্যা দূরীকরণে আমেরিকান মারথি মিশন কর্তৃক ১৯২৫ সালে নিয়োজিত হন। তিনি বোম্বের বস্তিবাসীদের অবস্থার উন্নয়নে ‘নাগপাদা নেইভরহুড হাউস' নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। যা সমাজকর্মমূলক কার্যক্রম পরিচালনের মাধ্যমে সমাজকর্মের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে ।
৩. পেশাদার সমাজকর্মীর প্রয়োজনীয়তা : 'নাগপাদা নেইভরহুড হাউস' এর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মীর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সে আলোকে 'Sir Dorabji Tata Graduate School of Social Work' প্রতিষ্ঠিত হয় । এটিই ছিল তৎকালীন প্রথম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৪ সালে এ প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তিত হয়ে Tata Institute of Social Science' নামে রূপান্তরিত হয় ।
৪. সমাজকর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : সমাজকর্ম শিক্ষার জন্য ১৯৪৬ 'সালে লক্ষ্ণৌতে 'Social Work Institute' এবং ১৯৪৭-৪৮ সালে দিল্লিতে 'Delhi School of Social Work' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পেশাদার সমাজকর্মী তৈরির প্রচেষ্টা চালু হয়। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজকর্ম শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিল । বর্তমানে সমগ্র ভারতবর্ষে ১৪০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক সমাজকর্ম বিভাগ চালু রয়েছে ।
৫. বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম বিভাগ প্রতিষ্ঠা : ১৯৬৪ সালে আমেরিকান বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত লক্ষ্ণৌতে Social Work Institute প্রতিষ্ঠা, ১৯৭৯ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় Delhi School of Social Work পৃথক বিভাগের মর্যাদালাভ এবং আমেরিকার আদলে বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'Social Work Faculty' প্রতিষ্ঠা সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশে এবং পেশাদারিত্ব অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
৬. গ্রন্থ প্রকাশ : ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে 'Social Welfare in India' নামক একটি তথ্যবহুল গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ে আলোচিত হয় আধুনিক সমাজকল্যাণের ধারণা, সমাজকল্যাণের নীতি ও কর্মসূচি এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। ১৯৮৬ সালে এ গ্রন্থ পরিবর্তন ও পরিবর্ধিত হয়ে 'Encyclopedia of Social Work' নামে প্রকাশিত হয়। যা ১৯৮৭ সালে আমেরিকার সমাজকর্ম বিশ্বকোষের অনুসরণে ৪টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
৭. পেশাগত সংগঠন : পেশাগত সংগঠন সমাজকর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং পেশার মানোন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে গঠিত হয় 'National Association of Professional Social Worker's যা পরবর্তীতে 'Association of School of Social Work in India' (ASSWI) প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এসব সংগঠন সমাজকর্ম বিকাশে তেমন অবদান রাখতে পারেনি।
৮. আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা : ভারতে পেশাদার সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। ভারতীয় সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমেরিকান বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, ভারতের সমাজকর্মী আমেরিকায় গিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ, সমাজকর্মের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, সমাজকর্মীদের Code of Ethics, Encyclopaedia প্রকাশ প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই আমেরিকার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ আমেরিকার আদলেই ভারতে সমাজকর্মের বিকাশ ঘটে
৯. সমাজকর্ম বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান : সমাজকর্ম বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন স্কুল, ইনস্টিটিউট, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগগুলো বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করছে। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এম ফিল ও পি এইচ ডি প্রদান করছে।
১০. সমাজকর্ম শিক্ষা পর্যালোচনা কমিটি : সমাজকর্ম শিক্ষার মানোন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজকর্ম শিক্ষার সমন্বয়সাধন, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও অনুশীলনের জন্য ১৯৬০ সালে প্রথম সমাজকর্ম শিক্ষা পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। যা ভারতে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ও উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা, মানবতাবোধ ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে সমাজকল্যাণ কার্যক্রম সূচনা হলেও কালক্রমে তা আরও উন্নতি ও দায়িত্বশীলতার সংমিশ্রণে পেশাদার সমাজকল্যাণের শুভ সূচনা ঘটায়। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজকর্ম হিসেবে সমাজকর্মের যতখানি উন্নয়ন হওয়া উচিত ছিল ততখানি হয়নি। তবে ধীরগতি হলেও পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ঘটেছে একথা বলা যায় ।