প্রাচীন ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
প্রাচীন ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
প্রশ্ন ২.৩৫ প্রাচীন ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর ।
অথবা, প্রাচীন ভারতের সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের প্রকৃতি বর্ণনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : প্রাচীন ভারতে বর্ণ প্রথার কারণে জনসমাজ কয়েকটি ধাপে বা শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল এবং তাদের কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টিত ছিল। প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম মৌর্য যুগ, মৌর্যোত্তর ও গুপ্তপূর্ব যুগ এবং গুপ্ত যুগ এই তিনটি যুগে বিভক্ত ছিল। তবে প্রাচীন ভারতে যারা সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতো তাদের সকলেই ছিল জ্ঞানীগুণী ধর্মানুরাগী ও মানবহিতৈষী ব্যক্তিবর্গ। তাই প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কাজের মধ্যে ব্যাপক বিচিত্রতা লক্ষ করা যায় ।
প্রাচীন ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর |
• প্রাচীন ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য : নিম্নে প্রাচীন ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো—
১. ধর্ম ও দর্শনের অনুশাসন : প্রাচীন ভারতে মানুষ ছিল ধর্মভীরু। তাই তারা দর্শন ও ধর্মের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ধর্ম ও দর্শনের অনুশাসন প্রাচীন ভারতের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে লক্ষ করা যায়। তাই পরকালের মুক্তির আশায় ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গরা অসহায় দুস্থদের সাহায্য করতো দান দক্ষিণার মাধ্যমে। প্রাচীন শাসকবৃন্দও একই কারণে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করত ।
২. মানবতাবোধ : মানবতাবোধ প্রাচীন ভারত সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে সময় মানবতাবাদী উদার ব্যক্তিরা অসহায়দের সাহায্য সহযোগিতা করতো। মানবতাবোধে অনুপ্রাণিত হয়েই মূলত তারা সমাজকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন করতো। আর এসব সমাজকল্যাণমূলক কাজ দুস্থ ব্যক্তিদের দুঃখদুর্দশা লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত ।
৩. রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা : রাজতন্ত্র প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তখনকার শাসনব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক। রাজা এবং তার নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো। জনকল্যাণের জন্য সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রাজা বা শাসকগণ দান খয়রাত, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুকুর খনন, খাল খনন, সরাইখানা ও আশ্রম নির্মাণ ইত্যাদি কার্যসম্পাদন করতেন। জনকল্যাণের ক্ষেত্রে এসব কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. সনাতন ধর্মের প্রভাব : প্রাচীন ভারতের সমাজসেবা ও জনসাধারণের ওপর সনাতন ধর্মের প্রভাব ছিল। মন্দিরগুলো থেকে দান খয়রাত করা হতো। হিন্দুধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে অনেক ধনবান ব্যক্তি পুকুর খনন, কূপ খনন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করতেন। জনকল্যাণের জন্য হিন্দু ধর্মগুরুরা বা প্রভাবশালীরা ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কাজ করতেন বলে হিন্দু ধর্মের প্রভাব- প্রতিপত্তি ছিল তখনকার সময়ে প্রবল ।
৫. অসংগঠিত সেবা কার্যক্রম : প্রাচীন ভারতে সমাজসেবা ছিল সম্পূর্ণরূপে অসংগঠিত ও অপরিকল্পিত। ফলে মানুষের জীবনমান স্থায়ীভাবে উন্নয়নে দান সদকা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারেনি। প্রাচীন ভারতের সমাজসেবা অসংগঠিত হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেবাদান। ব্যক্তি তার ইচ্ছামতো দান করতো বলে তা ছিল অসংগঠিত ও অপরিকল্পিত ।
৬. কঠোর বর্ণভেদ প্রথা : প্রাচীন ভারতে সমাজব্যবস্থায় বর্ণভেদ প্রথা ছিল চরম পর্যায়ে। হিন্দুধর্মের বর্ণভেদ প্রথা নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের ওপর এমনভাবে প্রভাব ফেলে যে, এর প্রভাবে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের আবির্ভাব ঘটে। আর জৈন ও বৌদ্ধধর্মের সহনশীল ও অহিংস মনোভাব বর্ণভেদহীন জীবন ব্যবস্থা নিম্নশ্রেণির হিন্দুদেরকে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের ভিত্তিতে জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। তখনকার সময়ের প্রচলিত বর্ণভেদ প্রথা মানুষের মধ্যে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, এর প্রভাব এখনো হিন্দুধর্মের মধ্যে রয়েছে।
৭. মঠ, মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা ও আশ্রম : প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মঠ, মন্দির বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। আর এসব শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে । প্রাচীন ভারতে শিক্ষাবিস্তারে মঠ ও মন্দিরগুলোই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। মঠ এবং মন্দিরগুলো শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি সন্ন্যাসীদের আশ্রম কেন্দ্র হিসেবেও ভূমিকা রাখত। মঠ ও মন্দিরগুলো আশ্রম কেন্দ্র হিসেবে দুস্থ, অসহায়দের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করতো বা দুস্থদের দুঃখদুর্দশা লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত ।
৮. কারিগরি ও চিকিৎসা বিদ্যা : প্রাচীন ভারতেও কারিগরি ও চিকিৎসা বিদ্যা অর্জনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি জনগণকে কারিগরি ও চিকিৎসা বিদ্যা প্রদান করা হতো এবং এর মাধ্যমে গরিব-দুঃখী, অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানে উৎসাহিত করা হতো। তাছাড়া কারিগরি ও চিকিৎসা শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে আয় উপার্জন ও জীবিকানির্বাহ করতে পারত।
৯. সরাইখানা, বিশ্রামাগার ও চিকিৎসালয় : প্রাচীন ভারতে সমাজসেবার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরাইখানা, বিশ্রামাগার ও চিকিৎসালয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রাচীন মানুষ পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতো। তাই দূরে যাত্রার ক্ষেত্রে সরাইখানা ও বিশ্রামাগারগুলো পথযাত্রীদের কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত । আর চিকিৎসালয়গুলো থেকে বিনামূল্যে দরিদ্র, দুস্থ, অসহায়দের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হতো।
১০. পরিবারকেন্দ্রিক সমাজসেবা : প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থা ছিল পরিবারকেন্দ্রিক। মাথাপিছু গণনার সময় ব্যক্তির পরিবর্তে পরিবারকে গণনা করা হতো এবং সাহায্য ও সেবা সহায়তাও পরিবারকে কেন্দ্র করে প্রদান করা হতো। এছাড়া পরিবারগুলো ছিল পিতৃ প্রধান এবং পরিবারের প্রধান পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও নির্ভরশীলদের নিরাপত্তা প্রদানে বাধ্য ছিল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থা ছিল বৈচিত্র্যময়তায় ভরপুর । মানবহিতৈষী ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে পরিচালিত সমাজসেবামূলক কার্যক্রম ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলো জনমানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে। তাই বলা যায়, প্রাচীন ভারতে অসংগঠিত ও অপরিকল্পিতভাবে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এগুলো সাধারণ মানুষের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।