প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও
প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও
প্রশ্ন ২.৩৪ | প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও ।
অথবা, প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও ৷
উত্তর ভূমিকা : মৌর্যযুগ থেকে শুরু করে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সম্রাট কর্তৃক যে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হতো সেগুলোকেই সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম বলা হতো। কেননা সে সময় জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা নির্ভর করতো নেতৃত্ব প্রদানকারী শ্রেণির ইচ্ছার ওপর। প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন শ্রেণি পেশাগোষ্ঠীর যেমন— ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি লোক বাস করতো আর এসব শ্রেণিতে নেতৃত্বদানকারী সম্পদশালীরা ধর্মীয় আনুগত্য ও মানবহিতৈষী কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও |
> প্রাচীন ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম : প্রাচীন ভারতে যেসব সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হতো সেগুলো কয়েকটি যুগে বা কয়েকটি শাসনামলে বিভক্ত ছিল। নিম্নে প্রাচীন ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমসমূহ যুগভিত্তিক আলোচনা করা হলো-
১. মৌর্য যুগে ভারতের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম : মৌর্য যুগের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এ যুগে ভারতে ব্যাপকভাবে বর্ণ প্রথা চালু ছিল । তারপরেও এসময় যেসব সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হতো নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো—
ক. বর্ণভিত্তিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন : এসময় সমাজের মানুষদের কয়েকটি বর্ণে বিভক্ত করে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । এসময় ব্রাহ্মণ সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল ধর্ম চর্চা, পূজার্চনা, অধ্যাপনা প্রভৃতি। অনুরূপভাবে, ক্ষত্রিয় শ্রেণির দায়িত্ব ছিল বিদ্যার্জন বা অধ্যয়ন, পূজা প্রদান, অস্ত্রবিদ্যা, জীবিত প্রাণীদের রক্ষা বা নিরাপত্তা প্রদান। তেমনিভাবে বৈশ্য সম্প্রদায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল বাণিজ্য, পশুপালন, পূজাঅর্চনা করা ও বিদ্যার্জন এবং শূদ্র সম্প্রদায়ের ওপর দায়িত্ব ছিল উপর্যুক্ত শ্রেণির সেবা প্রদান, বার্তাবহন ও কারুশিল্পীর ভূমিকা পালন ।
খ. কৃষি উন্নতি : মৌর্য যুগে সমাজকল্যাণ কার্যক্রম হিসেবে কৃষি উন্নয়নের জন্য সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে খাল ও জলাধার নির্মাণ করা হয়। কৃষকদের সুবিধার জন্য যৌথভাবে বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগে সেচের ব্যবস্থা করা হয়। গো- মহিষদের জন্য সরকারিভাবে নির্দিষ্ট গোচারণ ভূমি প্রদান করা হয়। এসময় কৃষকরা ধান, গম, যব, ভুট্টা, মটরশুটি প্রভৃতি ফসল উৎপাদন করতো।
গ. শস্যাগার : প্রাচীন ভারতে দুর্যোগের সময় বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরবর্তী সময়ে যেন প্রজাদের কোনো খাদ্য সংকটে প্রজাদের না পড়তে হয় সেজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে শস্যাগার গড়ে তোলা হয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ আপদকালীন সময়ে সমাজসেবা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রজাদের রাষ্ট্রীয় শস্যাগার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য প্রদান করা হতো ।
২. মৌর্যোত্তর ও গুপ্তপূর্ব যুগে ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম : নিম্নে ভারতে মৌর্যোত্তর ও গুপ্তপূর্ব যুগের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম তুলে ধরা হলো-
ক. মানবাধিকার : মানবাধিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রাচীন ভারতে সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিল। সকল ব্যক্তি তার অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেত। প্রাচীন ভারতে বর্ণ প্রথার প্রচলন থাকলেও নারী শিশুরা মানবাধিকারে অংশ হিসেবে বিশেষ সুবিধা পেত । বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা নিম্নশ্রেণিদের নিকট তাদের ধর্মপ্রচার করতে পারত। তাছাড়া জীবকুল বা মানব শিশুদের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতো তবে সে স্বর্গবাসী হবে বলে ধারণা প্রচলিত ছিল যা ঐ সময় ব্যক্তিদের মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে অনুপ্রাণিত করতো।
খ. প্রাণিকুলের প্রতি ভালোবাসা : প্রাচীন ভারতে প্রাণিকুলের প্রতি ছিল বিশেষ ভালোবাসা। এসময় সমগ্র ভারতবর্ষে প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল। তাছাড়া এসময় কেউ প্রাণী হত্যা করলে সে যে সম্প্রদায়ের লোক হোক না কেন তাকে শাস্তি ভোগ করতে হতো। অর্থাৎ প্রাণী হত্যার শাস্তি ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের কোনোরূপ পার্থক্য ছিল না।
গ. রাস্তাঘাট নির্মাণ : প্রাচীন ভারতে মৌর্যোত্তর যুগের সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়। এসময় পাটলিপুত্রের সাথে তাম্রলিপির দ্রুত যোগাযোগের জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়। উত্তর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে শ্রাবস্তী থেকে রাজগৃহ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়। তাছাড়াও আরেকটি রাস্তা উভয় ভারতের নদী উপত্যকা বরাবর পূর্ব-পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
৩. গুপ্ত যুগে ভারতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম : গুপ্ত যুগে ভারতবর্ষের সমাজকল্যাণ কার্যক্রম সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো-
ক. পরিবার কল্যাণ সমাজসেবা : প্রাচীন ভারতে পরিবারগুলো ছিল পিতৃতান্ত্রিক ও যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক, যার জন্য তখনকার সময়ে লোক গণনা মাথাপিছু না করে পরিবারপিছু করা হতো এবং সেবা সহায়তাও করা হতো পরিবারভিত্তিক। পরিবারের প্রধানের ওপর পরিবারের অন্যান্য সদস্য যেমন— বৃদ্ধ, শিশু, নির্ভরশীলদের লালনপালন ও নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব ছিল । গ্রামের বিশপতি ছিলেন তখনকার পঞ্চায়েত প্রধান। তার ওপর গ্রামীণ কল্যাণের সার্বিক দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল, তবে তখনকার সমাজের মূলভিত্তি ছিল পরিবার। পরিবারের প্রধানের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদিত না হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো।
খ. শিল্প ও সাহিত্যকর্ম : প্রাচীন ভারতে ব্যাপকভাবে শিল্প ও সাহিত্য চর্চা হতো। আর এসব শিল্পসাহিত্যের জন্য ছিল মানবহিতৈষী ব্যক্তি, রাজা বাদশাগণ। যেসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যেত তার মধ্যে নৃত্য, সংগীত, চারুশিল্পী, নাটক ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য ।
গ. মন্দির প্রতিষ্ঠা : প্রাচীন ভারতের গুপ্ত যুগে সমাজকল্যাণমূলক কার্যাবলির মধ্যে অন্যতম ছিল মন্দির প্রতিষ্ঠা । আর এসব রাজ্যের মানবহিতৈষী ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে স্থাপন করা হতো। এছাড়া দেবকুল মন্দির নির্মাণ, অগ্নি দেবীর পৃষ্ঠপোষকতা, মুদ্রাতে অগ্নি দেবীর প্রতিচ্ছবি অঙ্কন প্রভৃতি কার্যাবলি সম্পাদন করা হতো।
ঘ. আশ্রম : প্রাচীন ভারতে গুপ্তযুগের আশ্রমগুলো সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আশ্রমে ৮টি বিভাগের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
ঙ. শিক্ষা : প্রাচীন ভারতে গুপ্তযুগে শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হতো। এসময় শিক্ষার বিকাশের জন্য আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল। সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে তখনকার সময়ে আশ্রমবাসীর মেয়েরা সাহিত্য চর্চা করতো। ছেলেমেয়েরা একত্রে শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাধা ছিল না। বৌদ্ধ বিহারগুলোকে শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তখনকার সময়ে তক্ষশিলা, বারানসি ও কাঞ্চি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল।
চ. পরিবেশের যত্ন ও দাতব্য চিকিৎসা : গুপ্তযুগে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য রাস্তার দুপাশে ছায়াদানকারী বৃক্ষরোপণ করা হতো পথচারীদের সুব্যবস্থার জন্য সরাইখানা ছিল। সাধারণ মানুষদের চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করা হতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতে নানা ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় । তাছাড়া প্রাচীন মানুষ ছিল ধর্মভীরু। তাই তারা ধর্মীয়, মানবপ্রেম ও সামাজিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে প্রাচীন ভারতে বিশেষ ব্যক্তিবর্গের এসব কার্যক্রমের সাথে রাজা ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গও সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম শুরু করে।