মধ্যযুগে ভারতে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও
মধ্যযুগে ভারতে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও
প্রশ্ন ২.৩৬ মধ্যযুগে ভারতে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও ।
অথবা, মধ্যযুগে ভারতে বেসরকারি সমাজসেবামূলক কার্যক্রম আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : মধ্যযুগে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন তৎকালীন সমাজ এবং ব্যক্তি জীবনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। সে সময় যারা বর্ণবৈষম্যসহ নানারকম বঞ্চনার শিকার ছিলেন তারা দলে দলে ইসলামের আশ্রয়ে সমবেত হন। ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শ এবং মানবতাবাদ তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে আন্দোলিত করে। ফলে মানবতার সেবায় অসহায়, দুস্থ এবং দরিদ্রদের কল্যাণসাধনে বেসরকারি পর্যায়ে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের ব্যাপক সূচনা হয় ।
মধ্যযুগে ভারতে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দাও |
● মধ্যযুগে ভারতে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম : নিম্নে মধ্যযুগে ভারতে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দেওয়া হলো----
১. সনাতন পদ্ধতিতে সমাজসেবা : মধ্যযুগের শুরুর দিকে ভারতবর্ষে সনাতন পদ্ধতিতে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। যেসব মুসলিম মনীষী বিভিন্ন দেশ হতে ভারতবর্ষে আগমন করেছিলেন তারা সনাতন পদ্ধতিতে সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তারা যেসব খানকাহ নির্মাণ করেছিলেন সেসব খানকাহসমূহকে কেন্দ্র করেই সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। নিম্নে তাদের কার্যক্রম তুলে ধরা হলো—
ক. খানকাহগুলো হতে অসহায়, দুস্থ, এতিম এবং বৃদ্ধদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো।
খ. খানকাহের পাশে যেসব লংগরখানা নির্মিত হয়েছিল সেখান থেকে দরিদ্র ব্যক্তিদের খাবারের ব্যবস্থা করা হতো।
গ. বিভিন্ন দেশ হতে আগত সুফি দরবেশগণ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, সরাইখানা, পুকুর, কূপ ও খাল খননের মাধ্যমে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন ৷
ঘ. ইহকাল এবং পরকাল সম্পর্কিত জ্ঞান বিতরণে আগত সুফি দরবেশগণ ভূমিকা রাখতেন ।
২. পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রম : মধ্যযুগে যখন বিভিন্ন দেশ হতে সুফি, সাধক, দরবেশগণ ধর্মপ্রচারের কাজে ভারতবর্ষে আসলেন তখন ভারতবর্ষে নানারকম বৈষম্য এবং বঞ্চনা বিরাজমান ছিল । তখন তারা বিভিন্ন পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন। এই পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে সব অনাথ, এতিম, দুস্থ, অসহায়, অত্যাচারিত, নির্যাতিত এবং বঞ্চিতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হতো। তারা মানুষদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রদান করতেন ।
৩. মধ্যযুগে ভারতে বিভিন্ন সুফি, সাধক, ফকির দরবেশ এবং তাদের গৃহীত সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম : ইসলাম বিজয়ের অনেক পূর্বেই বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক, সাধক বা মনীষী ভারতবর্ষে আগমন করেন। এসব সুফি সাধক, ফকির দরবেশ, তৎকালীন সমাজে ইসলাম ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের সমাজকল্যাণ বা সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের বিবরণ দেওয়া হলো-
ক. হযরত শাহজালাল (রহ.) : হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমসমূহ নিম্নরূপ :
i. হযরত শাহজালাল (রহ.) সিলেটে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে বিভিন্ন ফকির দরবেশ, সুফি সাধক এবং পরিব্রাজক ও দরিদ্রদের মিলন মেলা গড়ে ওঠে।
ii. তৎকালীন সময়ে সিলেটের অত্যাচারী শাসক গৌড় গৌবিন্দের হাত থেকে সিলেটবাসীকে রক্ষা করেন
iii. তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন ।
iv. তিনি সিলেটে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন ।
খ. শেখ জালাল উদ্দিন তিরমিজী (রহ.) : শেখ জালাল উদ্দিন তিরমিজী (রহ.) এর সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
i. তিনি বিভিন্ন খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখান থেকে গরিব অসহায় এবং দুঃস্থ লোকদের সেবা ও সহায়তা প্রদান করতেন ।
ii. তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং লংগরখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
iii. তিনি নির্যাতিত, অসহায় এবং বঞ্চনার শিকার লোকদের সহায়তা প্রদান করতেন ।
গ. হযরত খানজাহান আলি (রহ.) : হযরত খানজাহান আলি (রহ.) একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক এবং ধর্মীয় ওস্তাদ হিসেবে খ্যাত । তার সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
i. ইসলামের খোলাফায়ে রাশেদিনের মতো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান ।
ii. মুসল্লিদের ইবাদতের জন্য তিনি বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন ।
iii. তিনি বিভিন্ন দীঘি, পুকুর এবং রাস্তা নির্মাণ করেন।
ঘ. হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) : হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) এর সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমসমূহ নিম্নরূপ :
i. দরিদ্র লোকদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য তিনি লংগরখানা স্থাপন করেন ।
ii. তিনি বিভিন্ন পুকুর এবং দিঘি খনন করেন,
iii. দরিদ্র এবং অসহায় ব্যক্তিদের আশ্রয় দান এবং সেবাদানের ব্যবস্থা করেন ।
ঙ. হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া : হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এর সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডসমূহ নিম্নরূপ :
i. তিনি মানুষের কল্যাণে পুকুর, দিঘি এবং কূপ খনন করেন এবং
ii. তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শিক্ষার প্রসার ঘটান ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মধ্যযুগে ভারতবর্ষে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমসমূহ মূলত বিভিন্ন মুসলিম মনীষী এবং সাধকগণ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনসেবা করার তাগিদ অনুভব করে সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করতো। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের ধরন ছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, রাস্তাঘাট, পুকুর, দিঘি, কূপ খনন, বিভিন্ন খানকাহ ও লংগরখানা প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করা ।