কৃত্তিবাস কেন বিখ্যাত
কৃত্তিবাস কেন বিখ্যাত
কৃত্তিবাস কেন বিখ্যাত |
উত্তর: কৃত্তিবাস রামায়ণের রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত। তাঁর রচিত রামায়ণ সর্বজনবিদিত। কৃত্তিবাস সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। তবে তিনি বাল্মীকির রামায়ণ অনুসরণে সর্বপ্রথম বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন।
তাঁর আত্মজীবনীতে যতটুকু জানা যায় তিনি গৌড়েশ্বরের দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। গৌড়েশ্বর নিয়ে সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভিন্নমত পোষণ করেন। সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে গৌড়েশ্বর হচ্ছেন রাজা গণেশের পুত্র জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৮-৩১)।
তবে উভয় গবেষকের মতপার্থক্য থাকলেও এটা নিশ্চিত যে, কৃত্তিবাস পনেরো শতকের শেষার্ধে জীবিত ছিলেন- -এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । বাল্মীকি রচিত মূল জাগতিক বৈষয়িক জীবনকথায় কৃত্তিবাসের হাতে মানবিক তত্ত্ব প্রবণতায় রূপ পায়। এক রামায়ণ শত-সহস্র প্রকার ।
“কে জানে প্রভুর লীলা কত অবতার।”—কৃত্তিবাস
কৃত্তিবাস জৈমিনি ভারত, নানা পুরাণ বা লোক প্রচলিত উপকথা থেকে কাহিনী তাঁর রামায়ণে সংযোজন করেছেন। বারো শতকের আগ থেকেই রাম অবতার রূপে বা বৈদান্তিক ব্রহ্মরূপে পুরাণে তাত্ত্বিক স্বীকৃতি পেলেও কৃষ্ণের মত উপাস্য ও পূজ্য হয়ে ইষ্টদেবতা হয়ে ওঠে নি। বিশেষত বাংলাদেশে রাম ইষ্টদেবতা বা উপাস্যের মর্যাদা কখনো সামাজিকভাবে পান নি।
সম্ভবত কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণের প্রভাবে বাঙালির ঘরোয়া জীবনে রাম-লক্ষণ-সীতা চরিত্র গভীর ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। বাঙালি হিন্দুর অন্তর্জীবন ও পারিবারিক, সামাজিক আচরণ আজও রাম-লক্ষণ-সীতার আদর্শে নিয়ন্ত্রিত।
বাংলা ভাষায় আদি রামায়ণ রচক কৃত্তিবাস। তিনি বাল্মীকি রামায়ণ হুবহু তর্জমা করেন নি । গ্রহণে বর্জনে সংযোজনে তা বলতে গেলে মৌলিক রচনাই । তাছাড়া আদর্শে, উদ্দেশ্যে ও বর্ণনায়ও স্বকীয়তা সর্বত্র প্রকট।
কৃত্তিবাসের রামায়ণের সব কাণ্ডেই বর্ণনাগত ও ভাষাগত আঞ্চলিক ও কালিক বিকৃতি, সংযোজন, বর্জন, সংক্ষেপণ প্রভৃতি এত অধিক ও বিচিত্র যে, তাঁর গ্রন্থ সম্পাদনায় আজ অবধি কেউ তেমন নির্ভরযোগ্য সাফল্য লাভ করেন নি ।
বাল্মীকির সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ অনুসরণে কৃত্তিবাস বাংলা মহাকাব্য রচনা করলেও তাঁর রামায়ণ ভাবের দিক থেকে সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি। বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব্য হিসেবে রচিত, কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালি হিসেবে পাঠ বা গীতের জন্য সৃষ্ট।
তাঁর কাব্যের রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, সরমা প্রমুখ চরিত্র বাঙালি জীবনাদর্শে রচিত। কৃত্তিবাসের রামায়ণে মানবিক দিক স্পষ্ট। সে কারণে পরবর্তীতে মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ' কাব্য সৃষ্টিতে কৃত্তিবাসের রামায়ণের প্রভাবই বেশি।