ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভারিজ রিপোর্টের গুরুত্ব বর্ণনা কর
ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভারিজ রিপোর্টের গুরুত্ব বর্ণনা কর
প্রশ্ন ২.২২] ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভারিজ রিপোর্টের গুরুত্ব বর্ণনা কর ।
অথবা, ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিকাশে বিভারিজ রিপোর্টের অবদান ব্যাখ্যা কর।
অথবা, যুক্তরাজ্যের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিকাশে বিভারিজ রিপোর্টের অবদান ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের সামাজিক নিরাপত্তার ইতিহাসে বিভারিজ রিপোর্ট একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল কাঠামো হচ্ছে বিভারিজ রিপোর্ট। সমাজের সব শ্রেণির নাগরিকের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে বিভারিজ রিপোর্ট প্রথম পূর্ণাঙ্গ পদক্ষেপ। বিভারিজ রিপোর্ট তৎকালীন ইংল্যান্ডের সমাজজীবনের গণবেকারত্ব, ব্যাপক দারিদ্র্য ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজের কল্যাণমূলক ব্যবস্থার পুনর্গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভারিজ রিপোর্টের
ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভারিজ রিপোর্টের গুরুত্ব বর্ণনা কর |
গুরুত্ব : ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভারিজ রিপোর্ট একটি মাইলফলক। বিভারিজ রিপোর্ট প্রণীত সামাজিক নিরাপত্তার ধারণা সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এক নতুন ধারণা ও নতুন সেবাগত কাঠামো দান করে। বিভারিজ রিপোর্ট শুধু ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো দান করেনি; বরং বিশ্বের সব দেশের অনুসরণীয় এক মডেল বা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছে। ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভারিজ রিপোর্টের ভূমিকা বা গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো—
১. সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন প্রণয়ন : বিভারিজ রিপোর্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হচ্ছে একটি একীভূত, সর্বাত্মক ও পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা। বিভারিজ রিপোর্টের এ সুপারিশের ভিত্তিতেই সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইনগুলো প্রণয়ন করা হয় । এ আইনগুলো হচ্ছে—
ক. ১৯৪৫ সালের পারিবারিক ভাতা আইন,
খ. ১৯৪৫ সালের জাতীয় বিমা আইন,
গ. ১৯৪৬ সালের জাতীয় বিমা (শিল্প দুর্ঘটনা) আইন,
ঘ. ১৯৪৬ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা আইন এবং
ঙ. ১৯৪৮ সালের জাতীয় সাহায্য আইন।
এসব আইনের মাধ্যমে পরবর্তীতে নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। তাই বলা যায়, আইনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো গঠনে বিভারিজ রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভূমিকা পালন করে।
২. কল্যাণমূলক ব্যবস্থার প্রবর্তন : বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী সমাজের সব শ্রেণিকে কল্যাণমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। এসব ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পারিবারিক ভাতা, বিমা সুবিধা, শ্রমিক ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। সমাজের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে বৈচিত্র্যময় ও বহুমুখী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার ধারণা প্রবর্তনে বিভারিজ রিপোর্ট অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৩. জাতীয় বিমা কর্মসূচির প্রবর্তন : বর্তমান বিশ্বের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রাণ বা মেরুদণ্ড বলতে হয় বিমা কর্মসূচিকে । আর বিমা কর্মসূচির ধারণা প্রথম প্রচলন করা হয় বিভারিজ রিপোর্টে। বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী সর্বাত্মক সামাজিক বিমা নিশ্চিত করার জন্য প্রণয়ন করা হয় জাতীয় বিমা আইন ১৯৪৬। এ জাতীয় বিমা কর্মসূচি ইংল্যান্ডের ৩৫ মিলিয়ন বিপর্যস্ত মানুষকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। তাই বলা যায়, ইংল্যান্ড তথা সারা বিশ্বের সামাজিক নিরাপত্তা ধারণার প্রাণ বা মেরুদণ্ড জাতীয় বিমা কর্মসূচি প্রচলনে বিভারিজ রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. পারিবারিক ভাতার প্রবর্তন : ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ পারিবারিক ভাতা ধারণার প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা করে বিভারিজ রিপোর্ট। বিভারিজ রিপোর্টের অন্যতম সুপারিশ হচ্ছে প্রথম শিশু বাদে পরবর্তী শিশুদের জন্য সাপ্তাহিক শিশু ভাতার (বর্তমানে পারিবারিক ভাতা) ব্যবস্থা করা। এ সুপারিশের ভিত্তিতেই প্রণয়ন করা হয় ১৯৪৫ সালের পারিবারিক ভাতা আইন । এ আইনের বিধান অনুযায়ী ১৬ বছরের নিচে একাধিক সন্তানবিশিষ্ট পরিবার দ্বিতীয় সন্তান থেকে পরবর্তী সন্তানদের জন্য ৯০ পেন্স করে ভাতা দেওয়া হতো। তাই বলা যায়, নির্ভরশীলদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী পারিবারিক ভাতা প্রবর্তনে বিভারিজ রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. সরকারি সাহায্য কার্যক্রম : বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশমালায় অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে যে সামাজিক বিমা কর্মসূচির বাইরের জনগণের জন্য জাতীয়ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারি সাহায্যের প্রবর্তন করা। আর এ সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয় ১৯৪৮ সালের জাতীয় সাহায্য আইন। এ আইনের আওতায় শিশুসহ সব স্তরের অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্যের ব্যবস্থা ছিল। তাই বলা যায়, সামাজিক নিরাপত্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সরকারি সাহায্য প্রবর্তনে বিভারিজ রিপোর্ট বিশাল ভূমিকা পালন করে ।
৬. জনস্বাস্থ্য সেবা : বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশে জনগণের জন্য ব্যাপকভাবে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু করার কথা বলা হয়। আর এ কার্যক্রমকে বেগবান করার জন্য প্রণয়ন করা হয় ১৯৪৬ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা আইন। বিভারিজ রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রণীত এ আইনে ব্রিটেনের সব নাগরিককে বিনা মূল্যে রোগ পরীক্ষা, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা চিকিৎসা চাহিদা পূরণে বিভারিজ রিপোর্টের গুরুত্ব অনেক। ব্রিটেনের চিকিৎসা কার্যক্রমের যুগোপযোগী কাঠামো প্রণয়নে বিভারিজ রিপোর্ট ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করে।
৭. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা : বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী অর্থনৈতিক বিপর্যয়কালীন গণবেকারত্ব মোকাবিলা করার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভারিজ রিপোর্টে বর্ণিত এ সুপারিশের ভিত্তিতেই সরকার অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৩% কোটা নির্ধারণ করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৩৪৯- ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য অর্ধশতাধিক আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এসব আইন দরিদ সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যখন ইংল্যান্ডের সমাজজীবনে এক নৈরাজ্যজনক অবস্থা বিরাজ করে ঠিক তখনই প্রণয়ন করা হয় বিভারিজ রিপোর্ট এবং এর ভিত্তিতে ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে। তাই বিভারিজ রিপোর্টকে ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড বা প্রাণ বলা হয় ।