ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিরবণ দাও
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিরবণ দাও
প্রশ্ন ২.৩৭ | ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিরবণ দাও ।
অথবা, ব্রিটিশ যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকল্যাণ কার্যক্রম আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ঐতিহ্যগত ধারার সমাজসেবা কার্যক্রম বিভিন্ন সমাজসংস্কার আন্দোলন এবং বিভিন্ন সামাজিক আইন প্রবর্তনের ভিতর দিয়ে সমাজকল্যাণে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয় । দানশীলতার পাশাপাশি মুক্ত যুক্তিবাদী ভাবধারা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের সমাজকল্যাণের পটভূমি গড়ে তোলে । ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটে। তাই ব্রিটিশ শাসিত সময়কেই আধুনিক সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের সূচনাকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিরবণ দাও |
● ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজকল্যাণ কার্যক্রম : ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজকল্যাণ কার্যক্রম দুভাগে বিভক্ত ছিল । যথা—
১. ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে সরকারি সমাজকল্যাণ কার্যক্রম : ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলো হলো—
ক. সমাজসংস্কার : ব্রিটিশ আমলে সরকারি পর্যায়ে জনসন্তুষ্টি নীতি এবং হিন্দু-মুসলমান অভিজাত শ্রেণির যৌথ প্রচেষ্টা সমাজকর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের নিয়ে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এবং লর্ড ডালহৌসি বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করে সমাজসংস্কার সাধন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কার হলো সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন, শিশু হত্যা ও নরবলি প্রথা রহিতকরণ, হিন্দু বিধবা আইন প্রবর্তন প্রভৃতি।
খ. সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন প্রণয়ন : ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশরা সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমে অবদান রাখেন। তাদের প্রণীত আইনগুলোর মধ্যে ১৯২৩ সালের শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন, ১৯২৩ সালের প্রভিডেন্ট ফান্ড আইন, ১৯৩৪ সালের কারখানা আইন, ১৯৩৪ সালের মাতৃকল্যাণ আইন উল্লেখযোগ্য। এ আইনগুলো শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, বৃদ্ধকালীন নিরাপত্তা বিধান ও মাতৃত্ব সুবিধা প্রদানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে ।
গ. শিক্ষা সম্প্রসারণ : ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক শিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা সম্প্রাসরণ ও উন্নয়নে লর্ড বেন্টিঙ্ক, লর্ড ডালহৌসি, লর্ড ক্যানিং ও ওয়ারেন হেস্টিংসের অবদান সবচেয়ে বেশি। তারা ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাসা স্থাপন, ১৮১৬ সালে হিন্দু কলেজ ও শ্রীরামপুর কলেজ, ১৮৫৯ সালে কলকাতা বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন । তাছাড়া ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শিক্ষা সম্প্রসারণ কার্যক্রমের একটি অনন্য উদাহরণ। এছাড়া ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ডের উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে দক্ষ সমাজকর্মী তৈরির জন্য Tata Graduate School of Social Work প্রতিষ্ঠা করে। যা এখনো সমাজকর্মের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
ঘ. শিশু ও নারী কল্যাণ : ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষে নারী ও শিশুদের কল্যাণে ব্যাপকভিত্তিক সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন, ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন, ১৮৫০ সালে শিক্ষানবিশ আইন, ১৮৫৭ সালে রিফারমেটরি অ্যাক্ট, ১৯২২ সালের বঙ্গীয় শিশু আইন, ১৯৩৩ সালের বঙ্গীয় পাপ ব্যবসা নিরোধ আইন প্রভৃতি নারী ও শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
ঙ. শ্রম কল্যাণ : শ্রমিকদের কল্যাণে ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে লর্ড ক্যানিং, লর্ড রিপন ও লর্ড ড্রাফিন ব্যাপক অবদান রাখেন। শ্রমিকদের কল্যাণে তাদের দ্বারা ১৮৮১ সালে শ্রমিক আইন পাশ, ১৯২৩ সালের প্রভিডেন্ট ফান্ড আইন, ১৯২৩ সালের শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন, ১৯৩৯ সালের মাতৃত্ব কল্যাণ আইন ও ১৯৩৪ সালের ভারতীয় কারখানা আইন উল্লেখযোগ্য।
চ. কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন : ভারতীয় উপমহাদেশে পল্লি এলাকার কৃষি সম্প্রসারণ ও সংস্কারে ব্রিটিশ শাসকদের আমলেই পরিকল্পিত কৃষি বিপ্লব শুরু হয় এবং কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। কৃষি উন্নয়নে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, Bengal Tenancy Act প্রণয়ন এবং কৃষি উৎপাদনে নিরাপত্তার জন্য চৌকিদারি আইন, ১৯০৯ সালে সমবায় সমিতি গঠন ও ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় কৃষিজীবী আইন প্রণয়ন প্রভৃতি ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে বেসরকারি সমাজকল্যাণ কার্যক্রম : ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনায় যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদ মনীষীগণ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবতাবাদী ও কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসে। তাই ভারতীয় উপমহাদেশে বেসরকারি সমাজকল্যাণ কার্যক্রমকে দুভাগে আলোচনা করা যায় । যথা :
ক. মহানুভব ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক পরিচালিত কার্যক্রম : ব্রিটিশ ভারতে জনগণের কল্যাণে মহানুভব ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন :
i. রাজা রামমোহন রায় : ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তার সবচেয়ে বড় অবদান লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্তৃক ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস করানো। এছাড়াও তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ii. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ব্রিটিশ শাসনামলে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে এক অনন্য নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি তৎকালীন হিন্দুদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাস করান। এছাড়াও তিনি দুস্থ অসহায়দের পাশে দাঁড়ান এবং নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন ।
iii. স্যার সৈয়দ আহমদ খান : ব্রিটিশ ভারতে সমাজসংস্কারক হিসেবে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান অন্যতম। তিনি ইংরেজদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞান সমিতি প্রতিষ্ঠা, মুসলিম শিক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি উচ্চপদে মুসলমানদের অধিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখেন ।
iv. হাজী মুহাম্মদ মুহসিন : সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে হাজী মুহাম্মদ মুহসিন বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি শিক্ষার জন্য তার সমস্ত সম্পত্তি ওয়াকফ করে যান। দরিদ্রদের জন্য মুহসিন ট্রাস্ট গঠন, দাতব্য চিকিৎসালয়, হুগলি কলেজ ও মাদ্রাসা স্থাপন, হুগলির ইমাম বাড়া প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গের 'হাতেম তাই' নামে অমর হয়ে আছেন ।
v. বেগম রোকেয়া : ব্রিটিশ ভারতে নারীরা ছিল সবচেয়ে অনগ্রসর। তাদেরকে অন্ধকার ভেদ করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেন বেগম রোকেয়া। নারী অধিকার ও নারী কল্যাণে তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত। তিনি মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, অবিবাহিত মেয়েদের বিবাহের ব্যবস্থা করেন। তার উল্লেখযোগ্য অবদান হলো সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল', 'আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম' ও ‘মুসলিম মহিলা সমিতি' প্রতিষ্ঠা। এছাড়াও ব্রিটিশ ভারতে যারা সমাজসেবায় বিশেষ অবদান রাখেন তারা হলেন, নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলি, একে ফজলুল হক, নওয়াব ফয়জুন্নেছা, স্বামী বিবেকানন্দ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, নওয়াব সলিমুল্লাহ প্রমুখ।
খ. বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত কার্যক্রম : ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন সংস্থা সমাজসেবার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্থাগুলো হলো-
i. মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি : ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব দূরীকরণ ও তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি ব্যাপক অবদান রাখে।
ii. ব্রাহ্মসমাজ : ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে কুসংস্কার - দূর করে সচেতন করে তোলা, সহমরণ প্রথা রহিতকরণ, শিক্ষার প্রসার, মদ্যপান নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যা কুসংস্কার দূরীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
iii. খ্রিস্টান মিশনারি : ভারতীয় উপমহাদেশে কুসংস্কার দূরীকরণ, শিক্ষার উন্নয়ন ও ধর্মপ্রচারে খ্রিস্টান মিশনারি ব্যাপক অবদান রাখে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এ সংস্থা ব্যাপক দায়িত্ব ও “ ভূমিকা পালন করে।
iv. আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম : ব্রিটিশ ভারতে অসহায় ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় ও কারিগরি শিক্ষা, বিনামূল্যে এম্বুলেন্স সেবা, এতিমখানা পরিচালনা, বেওয়ারিশ লাশ দাফন, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা ব্যাপক সমাজকল্যাণমূলক ও সমাজসংস্কারমূলক কার্যাদি সম্পন্ন হয়। তাছাড়া তৎকালীন মানবতাবাদী ব্যক্তিগণ ও বিভিন্ন সমাজকল্যাণ সংস্থাও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। তারা সমাজে চালু করেন জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠা করেন কল্যাণকর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যা সমাজকল্যাণের গতিপথকে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করে।