আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নীতিমালা এবং কার্যাবলি আলোচনা কর

আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নীতিমালা এবং কার্যাবলি আলোচনা কর

প্রশ্ন ২.২৯। আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নীতিমালা এবং কার্যাবলি আলোচনা কর।

অথবা, আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতিমালা ও কর্মসূচি বর্ণনা কর।

উত্তর ভূমিকা : ১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ গোটা জীবন ব্যবস্থাকে আমূল পাল্টে দেয়। আর এ গৃহযুদ্ধের অনিবার্য ফল হিসেবে দেখা দেয় ১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দা। এ অর্থনৈতিক মন্দা আমেরিকার সমাজে ব্যাপক বেকারত্ব, গণদারিদ্র্য, হতাশা, ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার মতো বহুবিধ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বয়ে নিয়ে, আসে। এর ফলে বিদ্যমান সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য কার্যক্রম অপ্রতুল প্রমাণিত হয়। যার কারণে ইংল্যান্ডের দান সংগঠন সমিতির আদলে আমেরিকাতেও ১৮৭৭ সালে দান সংগঠন সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয় ।

আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নীতিমালা এবং কার্যাবলি আলোচনা কর
আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নীতিমালা এবং কার্যাবলি আলোচনা কর

আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয়ভাবে সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সাহায্য কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুমধ্যকার অনর্থক প্রতিযোগিতা ও সাহায্যের পুনরাবৃত্তি রোধ করে সাহায্য ব্যবস্থায় গতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দান সংগঠন সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমেরিকায় দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে W. A. Friedlander বলেন, "It's aim was to help the poor more effectively by avoiding the wasting of money competition and duplication of work among the relief societies." নিম্নে আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলো-

১. দরিদ্র সাহায্য ও ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনাকারী সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের মধ্যকার অনর্থক প্রতিযোগিতা বন্ধ করা।

২. সাহায্য কার্যক্রমে পরিলক্ষিত দ্বৈত সাহায্য দান ও সাহায্য ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ করা ।

৩. অর্থহীন প্রতিযোগিতা ও সাহায্যের পুনরাবৃত্তি রোধ করার মাধ্যমে অর্থের অপচয় রোধ করা। 

৪. সাহায্য লাভের উপযুক্ত ব্যক্তিকে সাহায্য প্রদান করা। 

৫. দারিদ্র্য সমস্যাকে পরিকল্পিত ও সংগঠিত কার্যকলাপের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে মোকাবিলা করা।

৬. তদন্তের মাধ্যমে দারিদ্র্যের প্রকৃতি নির্ধারণ করে উপযুক্ত সাহায্যের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।

● আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির নীতিমালা : দান সংগঠন সমিতি তার বৃহত্তর লক্ষ্য আদায়ের জন্য কতকগুলো আদর্শ, দর্শন ও মূলনীতির ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে । নিম্নে দান সংগঠন সমিতির নীতিমালা উল্লেখ করা হলো— 

১. স্থানীয় দান সংগঠন সমিতির সদস্যদের সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের বোর্ড গঠন করে এদের মাঝে সহযোগিতা করা। 

২. কেন্দ্রীয়ভাবে একটি গোপন রেজিস্টার তৈরি করা 

৩. বন্ধুভাবাপন্ন পরিদর্শকদের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থীর আর্থসামাজিক অবস্থা তদন্ত সাপেক্ষে সাহায্যের ধরন নিরূপণ করা । 

● আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির কার্যক্রম : নিম্নে আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির কার্যাবলি আলোচনা করা হলো-

১. দরিদ্রতার কারণ অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম : আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সাহায্যের জন্য আবেদনকারী দরিদ্রের প্রকৃত অবস্থা জেনে তার জন্য উপযুক্ত সাহায্য কার্যক্রম গ্রহণ করা । এক্ষেত্রে COS এর অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম দারিদ্র্যের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে তার সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেওয়ার জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তৎকালীন সময়ে দরিদ্রতার জন্য দায়ী বেশ কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন— অলসতা, শারীরিক অক্ষমতা, অজ্ঞতা, উদাসীনতা, পাপাচার, জুয়াখেলা, রোগ ইত্যাদি। COS অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সাহায্য গ্রহীতার আর্থসামাজিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার দারিদ্র্যের মূল কারণ খুঁজে  বের করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করে।

২. আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা : COS দরিদ্রদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির প্রয়োজনে বিভিন্ন আইন প্রণয়নের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব করে। COS এর প্রস্তাব করা খাতসমূহের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নয়ন, যক্ষ্মা প্রতিরোধ, দরিদ্রদের বাসস্থান বস্তি পুনর্গঠন ইত্যাদি। এসব নেতিবাচক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য COS বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করে ।

৩. চাকরিসংক্রান্ত কার্যক্রম : দান সংগঠন সমিতি সক্ষম বেকার ও ভবঘুরেদের কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার পক্ষপাতি ছিল। এজন্য COS কর্মসংস্থান ব্যুরো, নিয়োগ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এবং এসবের মাধ্যমে সক্ষমদের বিভিন্ন কারখানায় কাজের সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়াও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করার জন্য ঋণদান সমিতি, লন্ড্রি স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

৪. পুনর্বাসনমূলক কার্যাবলি : দান সংগঠন সমিতি অক্ষম, বিকলাঙ্গ, পঙ্গু, প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করে। বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব নির্ভরশীল শ্রেণির পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় ।

৫. শিশু রক্ষামূলক কার্যাবলি : COS শিশুদের মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি বাস্তবায়ন করে থাকে। এসব কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন, নার্স সার্ভিস, শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা, গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প, শিশুদের নার্সারি বিভাগ ইত্যাদি। এসব কার্যাবলি শিশু রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণপোষণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে ।

৬. প্রবেশন কমিটি গঠন : দান সংগঠন সমিতি কিশোর অপরাধীদের আচরণ সংশোধনের জন্য ১৯০০ সালে বাফেলোতে প্রতিষ্ঠা করে প্রবেশন কমিটি। প্রাথমিক পর্যায়ে গৃহীত কার্যাবলির সফলতার প্রেক্ষিতে পরে অন্যান্য শহরেও অনুরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় । 

৭. সরকারি ভর্তুকি গ্রহণ : দান সংগঠন সমিতি দরিদ্র কল্যাণ কার্যক্রমকে বেগবান ও লক্ষ্যমুখী করতে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি গ্রহণ করে। পাশাপাশি COS এ জাতীয় অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে ।২. আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা : COS দরিদ্রদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির প্রয়োজনে বিভিন্ন আইন প্রণয়নের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব করে। COS এর প্রস্তাব করা খাতসমূহের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নয়ন, যক্ষ্মা প্রতিরোধ, দরিদ্রদের বাসস্থান বস্তি পুনর্গঠন ইত্যাদি। এসব নেতিবাচক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য Cos বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করে ।

৮. আইন ও আদালতসংক্রান্ত কার্যাবলি : দান সংগঠন সমিতির কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাজের সবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য COS শিশুশ্রম আইন ও কারখানা সংস্কার আইন প্রণয়ন করে। এছাড়াও COS শিশু ও যুবক শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আলাদা আলাদা আদালত স্থাপনের প্রতি জোর দেন ।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমেরিকায় দান সংগঠন সমিতি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল সাহায্য কার্যক্রমে প্রতিযোগিতা ও পুনরাবৃত্তি রোধ করে সাহায্য কার্যক্রমের ব্যয় হ্রাস করা। COS তার মূলনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করার জন্য ব্যাপক বিস্তৃত ও বহুমুখী কার্যাবলি গ্রহণ করে থাকে । আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির দর্শন ও মূলনীতি আধুনিক পেশাগত সমাজকর্মের পদ্ধতির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ