আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর
আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর
প্রশ্ন ২.২৭ | আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনা কর ।
অথবা, আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : আমেরিকা ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের উপনিবেশ থাকায় ব্রিটেনের অনুকরণ ও অনুসরণে আমেরিকার দরিদ্র কল্যাণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সমাজকর্ম একটি স্বীকৃত সাহায্যকারী পেশা। বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম পেশার ব্যাপক বিকশিত হওয়ার মূলে আমেরিকার সমাজকর্ম কার্যক্রমের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। আমেরিকায় পেশাগত সমাজকর্মের বিবর্তন বা বিকাশ মূলত কতকগুলো ধারাবাহিক পদক্ষেপের সমষ্টি ।
আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর |
আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন : আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশে ইংল্যান্ডের অনুকরণীয় সমাজ- কল্যাণমূলক কার্যক্রম, ১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দা, দান সংগঠন সমিতি, ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নিম্নে আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন আলোচনা করা হলো--
১. দান সংগঠন সমিতি ও সমাজকর্মের সূচনা : ১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে স্থবির করে দেয় । যার ফলশ্রুতিতে ১৮৭৩ সালে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । এ মন্দা ব্যাপক বেকারত্ব, হতাশা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা তথা দরিদ্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদ্যমান সমাজকল্যাণ ব্যবস্থাকে অপ্রতুল প্রমাণ করে। ত্রাণ কার্যক্রমে অর্থের অপচয় রোধ, ত্রাণ সমিতির অনর্থক প্রতিযোগিতা ও সাহায্যের পুনরাবৃত্তি রোধ করে দরিদ্রতাকে স্থায়ীভাবে মোকাবিলা করার জন্য ইংল্যান্ডের অনুকআমেরিকাতেও ১৮৭৭ সালে দান সংগঠন সমিতি গঠন করা হয়। দান সংগঠন সমিতি এ বিশৃঙ্খল সমাজকল্যাণ কার্যক্রমকে শৃঙ্খলিত করতে সাহায্য করেছে এবং পেশাগত সমাজকর্মের ভিত্তি রচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
২. পেশাগত শিক্ষার বিকাশ : সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের সূতিকাগার ইংল্যান্ড হলেও সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশে আমেরিকা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পেশাগত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ করে তোলা যায়। পেশাগত কর্মীদের প্রশিক্ষণের সুপারিশ করেন এনা এল. ডয়েস। যার ভিত্তিতে ম্যারি রিচমন্ড Traning School for Applied Philanthropy' প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলই সর্বপ্রথম ছয় সপ্তাহব্যাপী সমাজকর্ম প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু করে। ১৯০১ সালে তা বর্ধিত করে ৮ মাসের কোর্স করা হয়। New York. School of Social Work ১৯৪০ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৬৩ সালে এ নাম পরিবর্তন করে Colombia School of Social Work রাখা হয়। এভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমেরিকায় সমাজকর্মীদের তাত্ত্বিক জ্ঞান, দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয় ।
৩. পত্রিকা প্রকাশ : বিশ্বের সব স্বীকৃত পেশার পেশাগত মান, মর্যাদা সমুন্নত ও বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে ঐ পেশার পেশাগত পত্রিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমেরিকায় ১৮৯১ সালে COS কর্তৃক 'Chariies review নামক সমাজকর্ম সম্পর্কিত পত্রিকা প্রকাশিত হয় । বিভিন্ন সময়ে আমেরিকাতে 'Lend A Hand', 'Charities Review ' এবং 'Charities' নামে সমাজকল্যাণসংক্রান্ত পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯১০ সালে সমাজকর্ম সম্পর্কিত উল্লিখিত পত্রিকাগুলো একত্রিত করে 'The Survey' নামক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ।রণে
৪. পেশাগত সংগঠন : সংশ্লিষ্ট পেশার পেশাগত আদর্শ মূল্যবোধ ও পেশাগত নৈতিক বিধিমালা প্রণয়নে পেশাগত সংগঠন অপরিহার্য হিসেবে কাজ করে । ১৯১৮ সালে আমেরিকায় চিকিৎসা সমাজকর্মী সমিতি' নামক প্রথম পেশাগত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও পেশাদার সমাজকর্মের আরও যেসব পেশাগত সংগঠন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯২১ সালের 'American Association of Social Workers', ১৯২৬ সালের মনস্তাত্ত্বিক সমাজকর্মী সমিতি । সর্বশেষ ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় National Association of Social Workers (NASW).
৫. প্রকাশনা : অন্যান্য পেশার মতো সমাজকর্ম পেশা ও পেশাগত সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে বিভিন্ন প্রকাশনা বের করা হয়। যেমন— "The Social Work' (ত্রিমাসিক), 'Social Work Year Book', 'Encyclopaedia of Social Work'. সমাজম অভিধান প্রভৃতি। এছাড়াও ১৯১৭ সালে ম্যারি রিচমন্ড কর্তৃক প্রকাশিত 'Social Diagnosis' নামক গ্রন্থ ।
৬. সমাজকর্ম পদ্ধতির বিকাশ : সমাজকর্মকে পদ্ধতিগত রূপদানে আমেরিকার কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । দারিদ্র্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ব্যক্তিকে কেস হিসেবে বিবেচনা করে দান সংগঠন সমিতির কর্মীরা ব্যক্তি সমাজকর্মএবং সেটেলম্যান্ট হাউজকর্মীরা দল সমাজকর্ম পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। এছাড়া আমেরিকার COS সমষ্টি সংগঠনের ধারণা সৃষ্টিতেও কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৭. পেশাগত নৈতিক মানদণ্ড : পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ড পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। NASW সর্বপ্রথম সমাজকর্ম পেশার নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে ১৯৫১ সালে। এটি ১৯৬০ সালে সংশোধিত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে । NASW কর্তৃক ১৯৬০ সালের স্বীকৃত নৈতিক মানদণ্ড ১৯৬৭ এবং ১৯৭৯ সালে আংশিক সংশোধন করা হয়।
৮. সামাজিক স্বীকৃতি : সামাজিক স্বীকৃতি পেশার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রমাণ করে। ১৯৩৩ সালে আমেরিকায় সমাজকর্ম পেশাকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমাজকর্মীদের লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম ও সমাজকর্ম পেশার সূত্রপাত হলেও সমাজকর্ম পেশার পরিপূর্ণতা এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে আমেরিকায়। আমেরিকায় সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ও পরিপূর্ণতা লাভ প্রায় দুশ বছরের প্রচেষ্টার ফসল। আমেরিকায় পেশাগত সমাজকর্ম ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়ে আজকের এ সর্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে।