আমেরিকায় ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং সমাজসেবা কার্যক্রমসমূহ বর্ণনা কর
আমেরিকায় ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং সমাজসেবা কার্যক্রমসমূহ বর্ণনা কর
প্রশ্ন ২.৩৩ | আমেরিকায় ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং সমাজসেবা কার্যক্রমসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, আমেরিকায় ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দার ফলশ্রুতিতে গৃহীত সমাজসেবামূলক কর্মসূচিসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা : বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকের গোড়ার দিকে আমেরিকার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে এক চরম বিপর্যয় ঘটে এবং এটি আমেরিকার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেয় আর এটিকেই আমেরিকার ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা বলে। ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণে লক্ষ লক্ষ লোক তাদের পুঁজি হারিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ করে এত বিপুল সংখ্যক লোক সাহায্যের জন্য আবেদন জানালে বিদ্যমান সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রম তাদের ভরণপোষণে ব্যর্থ হয়। ফলে নতুন করে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যক্রম গৃহীত হয় ।
আমেরিকায় ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং সমাজসেবা কার্যক্রমসমূহ বর্ণনা কর |
আমেরিকায় ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা : আমেরিকার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের ১৯২৯ সালে এক মহা বিপর্যয় দেখা দেয়। এতে করে আমেরিকার আর্থসামাজিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের সবকিছু হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। একে আমেরিকার ইতিহাসে Great Economic Depression হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । এ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাদেরকে নৈরাজ্য ও হতাশা ঘিরে ধরে এবং অভাব জনিত আশঙ্কার কারণে মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা সম্পর্কে A. E. Fink বলেন, “মন্দা বলতে বুঝায় লক্ষ লক্ষ জনগণ তাদের পরিবারের জীবনধারণের জন্য উপার্জন করতে অক্ষম।” আর আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দায় এ ধরনের অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দা আমেরিকার প্রচলিত সমাজকল্যাণ কর্মসূচিকেও ব্যর্থ করে দেয় । মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকাতে প্রায় ১২ লাখ লোকেরও বেশি মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। এতে করে সাহায্য ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেয়। আমেরিকার বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থাগুলো সাহায্য সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয় । এমনকি আমেরিকার রাজ্য সরকার এবং ফেডারেল সরকারও সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। ফলে মানুষের জীবন মান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব দূর করার জন্য আমেরিকার ফেডারেল সরকারকে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হয় ।
●আমেরিকায় ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দার ফলে গৃহীত সমাজসেবামূলক কার্যক্রমসমূহ : নিম্নে ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা মোকাবিলা করার জন্য গৃহীত সমাজসেবামূলক কার্যক্রমগুলো আলোচনা করা হলো—
১. জরুরি কর্মসংস্থান কমিটি : ১৯২৯ সালে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে বিপর্যয়ের কারণে পুঁজি হারিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা পুঁজির মাধ্যমে অনেকে তাদের জীবিকানির্বাহ করতো। এরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে জীবিকার উপায় হারানো এসব লোকদের কাজের ব্যবস্থা করা। এ লক্ষ্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুভার ১৯৩০ সালে গভর্নরদের সম্মেলনে 'জরুরি কর্মসংস্থান কমিটি' গঠন করেন। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন কর্নেল আর্থার উডস। এ কমিটি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ধনী ব্যক্তি ও সাধারণ জনগণের কাছে বেকারত্ব দূরীকরণে সাহায্যের আবেদন এবং হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার আবেদন জানায়। জরুরি কর্মসংস্থান কমিটির স্লোগান ছিল 'Spread the work and Give a work' অর্থাৎ, কর্মক্ষেত্র বাড়াও এবং কাজের সুযোগ দাও । জরুরি কর্মসংস্থান কমিটি সাধারণ জনগণের আশানুরূপ সাড়া জাগাতে পারেনি
২. অস্থায়ী জরুরি ত্রাণ সাহায্য প্রশাসন : জরুরি কর্মসংস্থান কমিটির ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তোলে । মহামন্দার এক বছরের মাথায় বেকারের সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরূপ পরিস্থিতিতে উদ্ভূত দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবিলায় ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা করা সরকারের মনোযোগের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় নিউইয়র্কে হ্যারি এল.
হপকিন্সকে নির্বাহী পরিচালক করে প্রথম অস্থায়ী জরুরি ত্রাণ সাহায্য প্রশাসন (Temporary Emergency Relief Administration (TERA) গঠন করা হয়। হ্যারি এল. হপকিন্স একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমাজকর্মী। তাই তিনি সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনায় অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সব রাজ্যের জন্য সাহায্যদান নীতি প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি তিনি একটি সাহায্যের মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেন। হপকিন্স ত্রাণ সাহায্য পরিচালনার পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে মনোযোগী হন। হপকিংসের ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ তৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা সফল ছিল ।
৩. ১৯৩২ সালের জরুরি ত্রাণ সাহায্য ও পুনর্গঠন আইন : মন্দা পরবর্তী সময় থেকে সরকার নানাবিধ উদ্যোগের মাধ্যমে বেকারত্ব মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৩২ সালের দিকে বেকার সমস্যা চরম আকার ধারণ করে। বেকাররা তাদের মৌলিক মানবিক চাহিদাসমূহ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। উদ্ভূত এ ব্যাপক বেকারত্ব মোকাবিলায় রাজ্য সরকার ব্যর্থ হলে ফেডারেল সরকার এগিয়ে আসার আবশ্যকতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৩২ সালের এ পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে ফ্রিডল্যান্ডার বলেন, বেকারত্বের মাত্রা এত বেড়ে যায় যে ক্রমাগতভাবে ক্ষুধা, রোগব্যাধী, পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যহীনতা, আত্মহত্যার মাত্রা বাড়তেই থাকে।
সচ্ছল শ্রেণির আয় ও সঞয় করার সামর্থ্য ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে থাকে। ঠিক এ পরিস্থিতিতে সিনেটর Edward Costigan এবং Robert La Follette ফেডারেল সরকারের ত্রাণ সাহায্যসংক্রান্ত একটি বিল কংগ্রেসে উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্টের সম্মতিতে ১৯৩২ সালে 'জরুরি ত্রাণ সাহায্য ও পুনর্বাসন আইন' পাস হয়। এ আইন পাস হওয়ার পর ত্রাণ সাহায্যের জন্য প্রচুর আবেদন জমা পড়তে থাকে । এত বিপুল পরিমাণ অর্থায়নের পরও সুষ্ঠুনীতি ও পরিকল্পনার অভাবে সমস্যার ইতিবাচক সমাধান দেওয়া সম্ভব হয়নি ।
8. Federal Emergency Relief Administration (FERA): মন্দা পরবর্তী বেকারত্ব মোকাবিলায় একের পর এক উদ্যোগ যখন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছিল ঠিক তখনই FERA গঠন করা হয়। ১৯৩২ সালে রুজভেল্ট আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন বেকারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৫০ লাখ। ১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট 'Federal Emergency Relief Act of 1933' প্রণয়ন করেন। এ আইনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার করার জন্য Federal Emergency Relief Administration (FERA) গঠন করা হয়। এর প্রধান প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় হপকিন্সকে। একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে বেকারত্ব মোকাবিলার জন্য কাজ করে। FERA প্রধান দুটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করে। উদ্দেশ্য দুটি ছিল যথা : i. মন্দার ফলে সৃষ্ট বেকারত্ব রোধের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ও ii. বেকারদের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ করার জন্য অনুদান দেওয়া । FERA তার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পাঁচটি কার্যক্রম পরিচালনা করে । যথা :
ক. ফেডারেল কর্ম বিভাগ,
খ. রাজ্যের সাথে সম্পর্ক বিভাগ,
গ. বিশেষ কর্মসূচি বিভাগ,
ঘ. গবেষণা, পরিসংখ্যান ও অর্থ বিভাগ ও
ঙ. পল্লি পুনর্বাসন বিভাগ ।
মন্দা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় FERA অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে। বেকারত্ব রোধের জন্য FERA গঠন করে National Re-employment Service এর মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
৫. নাগরিক কর্ম প্রশাসন : প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট শ্রমিকদের কর্মসুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে গঠন করেন নাগরিক কর্ম প্রশাসন বা Civil Work Administration (CWA)। CWA ফেডারেল সরকার কর্তৃক পরিচালিত। এর মাধ্যমে শ্রমিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করে কাজের যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। CWA এর প্রধান প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় হ্যারি এল. হপকিন্সকে ।
৬. কর্ম প্রকল্প প্রশাসন : মন্দাজনিত বেকারত্ব মোকাবিলায় ১৯৩৩ সালে গঠিত কর্ম প্রকল্প প্রশাসন (Works Project Administration -WPA) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। FERA এবং CWA এর সমালোচনা দূর করে একটি যুযোপযোগী ব্যবস্থা হিসেবে গঠন করা হয় WPA। WPA পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক সফল ছিল। WPA দেশের ৭৯ লাখ বেকার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে, ৪৭ হাজার মাইল মহাসড়ক, রাস্তা ও পুল নির্মাণ করে এবং ৯০ হাজার সরকারি ভবনের ব্যবস্থা করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯২৯ সালের মহামন্দা আমেরিকার ইতিহাসে এক ক্রান্তিকালীন অধ্যায়ের সূচনা করে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ বিপুল সংখ্যক লোকের কাজের ব্যবস্থা করা সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। মন্দাজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলা কার্যক্রম নতুন গতি পায় ১৯৩২ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর। রুজভেল্টের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত FERA, CWA এবং WPA উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে।