১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা কর
১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা কর
প্রশ্ন ২.১৩। ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা কর ।
অথবা, ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের সবল দিক ও দুর্বল দিকগুলো বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন এমন একটি বিশেষ সময়ে ত্রাণ কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রণয়ন করা হয় যখন ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের জয়জয়কার। কারখানাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা সৃষ্ট নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বিদ্যমান আইন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিল। আর এই ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে প্রণয়ন করা হয় ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন। এ আইনের কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও এটি সময়ের পরিক্রমায় এই আইনের কতিপয় নেতিবাচক দিকও পরিলক্ষিত হয়।
১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা কর |
১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক : নিম্নে ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো-
ইতিবাচক বা সবল দিক : নিম্নে ১৮৩৪ সালের সংস্কার আইনের ইতিবাচক বা সবল দিকগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সরকারের ব্যয় হ্রাস : ১৮৩৪ সালের আইন দরিদ্র সাহায্য কার্যক্রমে সরকারের ব্যয় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা হয়েছিল
২. রোগপ্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ : রাজকীয় কমিশন অনুসন্ধানের মাধ্যমে দারিদ্র্যের মূল কারণ হিসেবে রোগব্যাধির ব্যাপকতাকে চিহ্নিত করেন। এ কমিশনের প্রচেষ্টায় কলেরা, টাইফয়েড ও গুটিবসন্ত প্রতিরোধের জন্য বিনা মূল্যে টিকাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
৩. শ্রমাগার ও দরিদ্রাগারের আধুনিকীকরণ : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের বিধান অনুযায়ী দুই শত নতুন শ্রমাগার নির্মাণ এবং পুরানো ও জীর্ণ শীর্ণ শ্রমাগার এবং দরিদ্রাগারগুলো সংস্কার করে আধুনিকীকরণের ব্যবস্থা করা হয় ।
৪. ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করা : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনে সক্ষম দরিদ্রদের জোরপূর্বক শ্রমাগারে কাজে বাধ্য করা হয়। যার ফলে ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক কমে যায়।
৫. বহিঃসাহায্যের প্রবর্তন : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন সক্ষম, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও সন্তান সন্ততিসহ বিধবাদের জন্য বহিঃসাহায্যের বিধান প্রচলন করে।
৬. কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বোর্ড প্রতিষ্ঠা : এ আইনের বিধান অনুযায়ী রাজা কর্তৃক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বোর্ড এ আইনের অর্থায়ন, পরিকল্পনা, কর্মসূচি গ্রহণ, বাস্তবায়নসহ যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে।
৭. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা : ১৬০১ সালের আইনের মতো ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনেও সক্ষম ভিক্ষুক ও ভবঘুরেদের কাজের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে তারা নিজের ও তার পরিবারের ভরণপোষণের সুযোগ পায় ।
৮. নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনে প্রতিবেশী প্যারিশের কার্যক্রমের সমন্বয় ও যোগাযোগসাধনের জন্য দরিদ্র আইন ইউনিয়ন গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে সব প্যারিশের কার্যক্রমে একটি ভারসাম্য আনয়ন করা সম্ভব হয় ।
৯. জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের আওতায় চ্যাডউইকের উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন করা হয়। এর মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রভৃতি গ্রহণ করা হয় ।
নেতিবাচক বা দুর্বল দিক : নিম্নে ১৮৩৪ সালের সংস্কার আইনের নেতিবাচক বা দুর্বল দিকগুলো আলোচনা করা হলো-
১. জোরপূর্বক কাজে প্রেরণ : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনে সক্ষমদের জোরপূর্বক কাজে বাধ্য করা হতো। এক্ষেত্রে সাহায্যপ্রার্থীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো না ।
২. পারিবারিক ভাঙন : বয়স ও সক্ষমতার ভিত্তিতে একই পরিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষে ভরণপোষণের ব্যবস্থা থাকায় তা পারিবারিক ভাঙনের সৃষ্টি করে ।
৩. মর্যাদাহানিকর : এ আইনে ভিক্ষাবৃত্তিকে চরমভাবে ঘৃণা করা হয় । দরিদ্রাগারে সাহায্যপ্রার্থীর জীবনমান নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী অপেক্ষা নিম্ন পর্যায়ে রাখা হয় ।
৪. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ : প্যারিশের পুরানো ও অব্যবহৃত স্যাঁতসেঁতে বাড়িগুলোকে শ্রমাগার ও দরিদ্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আলো বাতাসের স্বল্পতাজনিত এসব কক্ষে গাদাগাদি করে বসবাস করায় তা নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায় ।
৫. নৈতিক অধঃপতন : শ্রমাগার ও দরিদ্রাগারের একই কক্ষে নারী- পুরুষ একসাথে অবস্থান করায় তা নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
৬. দরিদ্রদের ঘৃণার চোখে দেখা : এ আইন পর্যালোচনা করে বলা যায়, তৎকালীন সময়ে দরিদ্রদের ঘৃণার চোখে দেখা হতো। তখন দরিদ্র হওয়াটাকে অপরাধের শামিল বলে মনে করা হতো।
৭. ব্যক্তিস্বাধীনতা নষ্ট করা : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনে সক্ষম ভিক্ষুক ও ভবঘুরেদের জোরপূর্বক কাজে বাধ্য করা হতো। এখানে সাহায্য গ্রহীতার মতামত প্রদান বা কাজ পছন্দ করার কোনো সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ সাহায্যগ্রহীতার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম ছিল না।
৮. মানবেতর জীবনযাপন : ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের অন্যতম নীতি ছিল দরিদ্র ত্রাণ কার্যক্রমে সরকারি ব্যয় হ্রাস করা। এ নীতির আলোকে দরিদ্রাগারগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য পরিমাণ সাহায্য প্রদান করা হতো এবং সাহায্য হিসেবে দেওয়া দ্রব্যের গুণগত মান ছিল খুবই নিম্নমানের। তাই বলা যায়, শ্রমাগার ও দরিদ্রাগারগুলোতে সাহায্যের নামে মানবেতর জীবনাযাপন করতে বাধ্য করা হতো।
৯. সমস্যার সাময়িক সমাধান : এ আইনের বিধান অনুযায়ী সক্ষম দরিদ্রদের কোনোরূপ প্রশিক্ষণ ছাড়া তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারেনি। আবার দরিদ্রাগারে অবস্থানকারী শিশুদের কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তাদের নামমাত্র বস্তুগত সাহায্য দেওয়া হতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন ১৬০১ সালের আইনের সমালোচনা দূরীভূত করে একগুচ্ছ কল্যাণমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করে। এ আইন তৎকালীন চাহিদা পূরণে অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে এ আইন সময়ের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। যার কারণে এ আইনের সমালোচনাও হয়েছে বেশ। বলা হয়ে থাকে, ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন ১৬০১ সালের আইনের দমন, নিপীড়ন ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করে।