সমাজকর্মের মানদণ্ড আলোচনা কর
সমাজকর্মের মানদণ্ড আলোচনা কর
প্রশ্ন ১.০১ ] সমাজকর্মের সংজ্ঞা দাও। সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর ।
অথবা, সমাজকর্ম কী? সমাজকর্মের মানদণ্ড আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : আধুনিক বিশ্বে সমাজকর্ম হচ্ছে বিজ্ঞাননির্ভর ও সমস্যা সমাধানকারী একটি সাহায্যকারী পেশা। এটি বর্তমান বিশ্বে গতিশীল পেশা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। সমাজকর্ম আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে সমস্যার ব্যাখ্যামূলক একটি বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী সমাধান বের করে। মূলত নতুন নতুন ও জটিল সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধানের লক্ষ্যেই সমাজকর্মের আবির্ভাব।
সমাজকর্মের মানদণ্ড আলোচনা কর |
সমাজকর্ম : সনাতন সমাজকল্যাণের আধুনিক পরিশীলিত রূপই হলো সমাজকর্ম। এটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্ভর সাহায্যকারী পেশা। শিল্পবিপ্লব সমাজে বহুমুখী ও জটিল সমস্যা সমাধানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে সমাজকর্ম পেশার উদ্ভব সমাজকর্ম হচ্ছে এমন একটি সাহায্যকারী পেশা, যা কতকগুলো সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে এমনভাবে সহায়তা করে যাতে তারা নিজেরা নিজেদের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয় ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সমাজকর্মের সংজ্ঞায় ডব্লিউ এ ফ্রিডল্যান্ডার ( W. A. Friedlandar) বলেন, "Social Work is a professional service based upon scientific knowledge and skill in human relations which assists individuals alone or in group to obtain social and personal satisfaction and independence." অর্থাৎ, সমাজকর্ম হচ্ছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও মানব সম্পর্কবিষয়ক এমন এক পেশাদার সেবাকর্ম যা সামাজিক ও ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি ও স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিকে এককভাবে অথবা দলগতভাবে সাহায্য করে।
জাতিসংঘ সচিবালয় (UNO) প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী এর মতে, সমাজকর্ম হলো এমন এক ধরনের কার্যাবলি, যা ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টির দ্বারা তাদের সাহায্য করতে চায়।
সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী, “সমাজকর্ম এমন একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান, যা মানুষকে মনোসামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার একটি কার্যকর পর্যায়ে উপনীত হতে সাহায্য করে এবং সব মানুষের কল্যাণকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে প্রভাবিত করে।”
Frank Watson বলেন, সমাজকর্ম একটি বিজ্ঞান ও কলা যার উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সাথে মানুষের সামঞ্জস্য এবং পরিবেশের সাথে মানুষের চাহিদার সামঞ্জস্য সাধন করে কল্যাণ বৃদ্ধি করা।”
National Association of Social Workers (NASW) এর মতে, "Social work is the professional activity helping individuals group or communities to enhanceor restore their capacity for social functioning and creating social conditions favorable to that goal." অর্থাৎ, সমাজকর্ম ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে সাহায্য করার এমন একটি পেশাগত কর্মকাণ্ড, যা তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালী করে এবং সামাজিক পরিবেশকে এ লক্ষ্যে উপযোগী করে গড়ে তোলে।
● সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য : নিম্নে সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করা হলো-
১. বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভিত্তিক পেশা : সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভিত্তিক একটি সাহায্যকারী পেশা। সমাজকর্মে সেবাদানকারীকে পেশাগত ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হতে হয়। সেজন্য সমাজকর্মীরা সুনির্দিষ্ট ও সুশৃঙ্খল পাঠ্যসূচি অধ্যয়ন করে পেশাগত কার্য পরিচালনা করেন । তাই একজন সমাজকর্মীকে সমাজ, সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক বিজ্ঞানের জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের যাবতীয় কৌশল সম্পর্কে শিক্ষালাভ করতে হবে।
২. পদ্ধতিনির্ভর সমাধান প্রক্রিয়া : সমাজকর্মের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পদ্ধতিনির্ভর সমাধান প্রক্রিয়া। এর নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে এটি সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। এজন্য সমাজকর্মের কতগুলো মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতি রয়েছে। মৌলিক পদ্ধতিগুলো হলো ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম ও সমষ্টি সংগঠন। আর সহায়ক পদ্ধতিগুলো হলো সমাজকম প্রশাসন, সমাজকর্ম গবেষণা ও সামাজিক কার্যক্রম, সমাজকর্মীরা এসব পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।
৩. সাহায্যকারী ও সক্ষমকারী পেশা : সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী ও সক্ষমকারী পেশা। এটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে এমনভাবে সাহায্য করে যা শুধু বর্তমান সমস্যাই নয়; বরং ভবিষ্যতে যেকোনো সমস্যায় পতিত হলে নিজেরাই যেন নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ সমাজকর্মীরা সমস্যাগ্রস্তদের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হতে সাহায্য করে ।
৪. পেশাগত কর্মকাণ্ড : সমাজকর্ম কোনো স্বেচ্ছামূলক সেবাকর্ম নয়; বরং এটি পেশাগত কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। সমাজকর্মীরা সেবাদানের ক্ষেত্রে তাদের পেশাগত নীতিমালা অনুসরণ করে চলেন। তাই পেশাগত সেবা প্রদান এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারণ পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন সমাজকর্মীদের পক্ষেই আধুনিক সমাজকর্মের পেশাগত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব।
৫. সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি : সমাজকর্মের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষকে বিচার করা। মানুষের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক দিকসহ জীবনের সব দিক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এসবের একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি উন্নয়নের কথা চিন্তা করা যায় না। তাই সমাজকর্ম মানুষের সবদিকের উন্নয়নে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে থাকে ।
৬. পেশাগত সংগঠন : পেশাগত সংগঠন পেশার মান উন্নয়নের জন্য কর্মীদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ, পেশাগত শিক্ষার্জনের জন্য যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ, পেশার উৎকর্ষতা সাধন পেশাকে জনগণের জন্য অধিকতর কল্যাণমুখী করে তোলা এবং পেশাদার কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সমাজকর্মে সুনির্দিষ্ট পেশাগত সংগঠন রয়েছে। সমাজকর্মের যেসব পেশাগত সংগঠন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে সেসব হলো Council on Social work Education (CSWE), International Association of Schools of Social Workers (IASSW), International Federation of Social Works (IFSW) প্রভৃতি ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজকর্মে উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়াও আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন— পেশাগত সম্পর্ক ও পারিশ্রমিক, সমন্বিত বিজ্ঞান, সার্বিক কল্যাণ, মূল্যবোধভিত্তিক পেশা প্রভৃতি। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর নির্ভর করেই সমাজকর্ম পেশা হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি সমাজকর্মকে অন্যান্য পেশা থেকে স্বকীয়তা দান করেছে। তাই পেশাগত সমাজকর্মীর উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যাবলির জ্ঞান থাকা আবশ্যক ।