সমাজকর্ম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর
সমাজকর্ম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর
১.১৬] রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। সমাজকর্ম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কী? সমাজকর্মের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে বৈসাদৃশ্য দেখাও।
উত্তর ভূমিকা : প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব এবং কোনো না কোনো রাষ্ট্রের অধিবাসী। রাষ্ট্র জীবন বিকাশের একটি প্রধান ক্ষেত্র। আর রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের সাধারণ জ্ঞানই হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। জীবনকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে হলে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের নিয়মনীতি, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এবং রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা একান্ত জরুরি। বিষয়বস্তুর দিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজকর্মের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু মূল্যবোধ ও পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ।
সমাজকর্ম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর |
* রাষ্ট্রবিজ্ঞান : রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে রাষ্ট্রবিষয়ক এমন একটি শাখা বা বিজ্ঞানকে বুঝায়, যা সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করে।
প্রমাণ্য সংজ্ঞা : অধ্যাপক লাস্কি (Prof Laski) বলেন, “সংগঠিত রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলোচনাই হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল (Aristotle) এর মতে, “রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমন একটি বিষয়— একটি সুসংগঠিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ নগররাষ্ট্রে আদর্শ জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয়ই যার অন্তর্ভুক্ত।”
জর্জ ক্যাটলিন (George Catlin) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো মানুষের কার্যাবলি ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পূর্ণাঙ্গ আলেখ্য।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লুন্টলি (Bluntschli) বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো সেই বিজ্ঞান যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় রাষ্ট্র যা রাষ্ট্রের মৌলিক অবস্থা ও অন্তর্নিহিত প্রকৃতি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকাশ ও বিবর্তন সম্বন্ধে পর্যালোচনা করে এর স্বরূপ অনুধাবনে সাহায্য করে।”
আর. জি. গেটেল (R. G. Gettell) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা করে।” রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান একাধারে বাস্তববাদী ও আদর্শবাদী বিজ্ঞান, যা ন্যায়নীতি অনুসন্ধানের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের আচরণঅধ্যাপক আর. এন. গিলক্রিস্ট (Prof. R. N. Gilchrist) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে।”
লাসওয়েল (Lasswell) এর মতে, “সমাজের অন্তর্ভুক্ত প্রভাব ও প্রভাবশালীদের ক্রিয়াকলাপের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাই হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্যারিস (Garise) বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের উৎপত্তি অগ্রগতি, উদ্দেশ্য এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য সকল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে।”
সমাজকর্ম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য : সমাজকর্ম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে যেসব পার্থক্য/বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়, নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো-
১. দৃষ্টিভঙ্গি : সমাজকর্ম মানুষকে সমাজিক জীব হিসেবে বিবেচনা করে । পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষকে প্রধানত রাজনৈতিক জীব হিসেবে গণ্য করে । সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে সামাজিক জীব এবং রাজনৈতিক জীবের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা ।
২. আওতা/পরিধি : মানবজীবনের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সমাজকর্ম আলোচনা করে। কিন্তু মানুষের নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রের কার্যাবলি আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল বিষয়বস্তু। ফলে সমাজকর্মের পরিধি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি অপেক্ষা ব্যাপক।কে নিয়ে আলোচনা করে।
৩. তাত্ত্বিক ভিত্তি : মানুষের সমস্যার সমাধানের জন্যই সমাজকর্মের সকল জ্ঞানের সমাহার। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। রাষ্ট্র ও নাগরিকতা সম্পর্কিত জ্ঞানদান করাই এর কাজ। সুতরাং তত্ত্বগত দিক থেকে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
৪. ক্ষমতা : বিপর্যয়মূলক কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সমাজকর্মের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে, সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। অন্যসব প্রতিষ্ঠান যেখানে ব্যর্থ, রাষ্ট্র সেখানে চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। সুতরাং ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
৫. প্রতিষ্ঠান : সমাজকর্ম মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষকে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে তাদের রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে সচেষ্ট। একই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং সমাজকর্ম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে বলে সমাজকর্মের পক্ষে রাষ্ট্রের নাগরিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করা সহজ হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিষয়বস্তুর পরিধি, দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতিসহ বিভিন্ন দিক থেকে সমাজকর্ম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। উভয়ের কর্মপ্রণালিও ভিন্ন। তবে কতিপয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নাগরিকদের মধ্যে যে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে তাই মানুষকে সমাজকর্ম সাধনে উদ্যোগী ও সফল করে তোলে। সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে জ্ঞান আহরণ করে সমাজকর্ম একটি প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক বিরাট অংশ সমাজকর্মে অনুশীলিত হয়ে থাকে।