উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর
উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর |
উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : সাম্প্রতিককালে প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ।
প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রে খুব মুষ্টিমেয় ব্যক্তিরই রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। শিল্পবিপ্লব ও যুক্তিবাদী জাগরণ থেকে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের দাবি ব্যাপকতা লাভ করে ।
বহুবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আজও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পায়নি ।
উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা : নিম্নে উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরা হলো :
১. গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব : উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব। উন্নয়নশীল দেশগুলো স্বাধীনতার পর উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেও তা কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
তার প্রধান কারণ হলো রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ জনগণ গণতান্ত্রিক চর্চায় অভ্যন্ত নয়। যার ফলে উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ নষ্ট হচ্ছে।
২. রাজনৈতিক কোন্দল : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো নয়। রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্পরকে শত্রু মনে করে। ফলে সামান্য কোনো বিষয় নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
এসব অ্য সাধারণ জনগণকে রাজনীতির প্রতি বিমুখ করে তোলে। ফলে তারা রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের দূরে রাখে।
৩. রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের অভাব : রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে বাক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবেশ, সংরক্ষিত এবং পরিবর্তিত হয়।
কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের অভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিগ এক হয় না, যা রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ।
৪. একাত্মতার সংকট : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অন্যতম একটি সমস্যা হলো একাত্মতার সংকট। এসব দেশে একাধিক নরগোষ্ঠী বা উপজাতি, নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠী রয়েছে।
এ কারণে সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত অনুভূতির সাথে জাতীয় চেতনা বা জাতিগত একক পরিচিতির অনুভূতির স্থাবস্থা বিরাজ করে, যা রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে।
৫. অনুগত রাজনৈতিক সংস্কৃতি : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পূর্ণমাত্রায় বিকশিত নয়। এসব দেশের অধিকাংশ জনগণ রাজনীতি বিষয়ে পূর্ণ সচেতন নয়।
জনগণের মধ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও মেরুকরণ লক্ষ করা যায়। জনগণ প্রায়ই সরকারের ধরন ও বৈধতা নিয়ে বিভক্ত থাকে।
মূলত রাজনৈতিক অংশগ্রহণের জন্য বিকশিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজন, যা উন্নয়নশীল দেশে অনুপস্থিত।
৬. জাতীয় সংহতির অভাব : জাতীয় সংহতি একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে জাতীয় সংহতি বিঘ্নিত হয়।
যার ফলে জনগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জাতীয় সংহতির অভাবে উন্নয়নশীল দেশে জাতিভিত্তিক অংশগ্রহণের তুলনায় সংকীর্ণ অংশগ্রহণ দেখা যায়।
৭. যথাযথ রাজনৈতিক অবকাঠামোর অভাব : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক বা সাংগঠনিক অবকাঠামোর অভাবে সরকার তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে না।
অর্থাৎ সরকার তার গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন ও কার্যকরী করতে পারে না আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে না পারার কারণে।
ফলে অনেক দেশে জনগণ সরকারের কর্মকাণ্ড, নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত নয়, যা অংশগ্রহণের মাত্রাকে সীমিত করে।
৮. দরিদ্রতা : বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিগণ অধিকহারে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অধিকাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
তাদের নিকট রাজনীতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অন্নসংস্থান। কাজেই দরিদ্রতা এসব দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রধান বাধা।
৯. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব : রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হলো জনগণকে সরকারে বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত করা।
এর ফলে জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে এবং তাদের মত প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পর্যাপ্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নেই।
ফলে সরকার জনগণকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ব্যাপারে সচেতন করতে ব্যর্থ হয়। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সীমিত হয় ।
১০. শিক্ষার নিম্নহার : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষার হার অনেক কম। ফলে নির্বাচনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত।
এ জনগোষ্ঠী সাধারণত নির্বাচনে বেশি সাড়া দেয়। বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচনে এদের অংশগ্রহণ অপেক্ষাকৃত বেশি।
এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড; যেমন- যোগাযোগ, রাজনৈতিক আলোচনা, প্রচার, সভাসমাবেশ, দলীয় সদস্য হওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভৃতিতে এদের অংশগ্রহণ খুবই কম। তাই শিক্ষার নিম্নহার উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকার জনগণের জন্য রাজনৈতিক অংশগ্রহণের, পর্যাপ্ত' সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়।
এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অজুহাতে সামরিক শাসনের আবির্ভাবের ফলে গণঅংশগ্রহণের মাত্রা আরও সীমিত হয়ে পড়ে।
সর্বোপরি গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, পর্যাপ্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব, দরিদ্রতা, শিক্ষার নিম্নহার, জাতীয় সংহতির অভাব প্রভৃতি উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করে তোলে।