সামাজিক পরিবর্তনের বাহনসমূহ আলোচনা কর
সামাজিক পরিবর্তনের বাহনসমূহ আলোচনা কর |
সামাজিক পরিবর্তনের বাহনসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন বাহন। সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কতকগুলো বিষয় বাহন হিসেবে কাজ করে।
এসব বাহনের প্রভাব বা ভূমিকার ফলেই সমাজে বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয় এবং গতানুগতিক সমাজের স্থলে আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন ঘটে।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ও জনপদে সামাজিক পরিবর্তনের ওপর প্রভাবসৃষ্টিকারী বাহনসমূহ একইরকম নয় ।
© সামাজিক পরিবর্তনের বাহন : সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে সামাজিক উপাদানসমূহের পরিবর্তন। অর্থাৎ সামাজিক কাঠামো, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তনকেই সামাজিক পরিবর্তন বলা হয়।
নিম্নে সামাজিক পরিবর্তনের বাহনসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. আশা-আকাঙ্ক্ষা : মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কর্মকাণ্ড সমাজজীবনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
তাই সমাজ গঠনকারী ব্যক্তিবর্গের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ড সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম বাহন হিসেবে বিবেচিত হয়। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তির কর্মের সমষ্টি সমাজের বৃহৎ পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে।
২. বিশ্বায়ন : বিশ্বায়নের এ যুগে উন্নয়নশীল সমাজসমূহ উন্নত সমাজগুলো দ্বারা অধিক মাত্রায় প্রভাবিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে নতুন ধরনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
এতে গতানুগতিক সমাজের সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিকতার পরিবর্তে বৈশ্বিক ভাবধারা গড়ে উঠেছে। এভাবে বিশ্বায়ন সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে কাজ করছে।
৩. বিপ্লব : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, ১৯৪৯ সালের চীনের বিপ্লব এবং অন্যান্য দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাজজীবনের সবক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে।
কাজেই বিপ্লব সামাজিক পরিবর্তনের একটি বাহন হিসেবে বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে পরিবর্তিত করে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে থাকে।
৪. এনজিওর কর্মকান্ড : বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের এনজিও দারিদ্র্য্য দূরীকরণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সক্ষমতা ও সচেতনতা তৈরির কাজ করে যাচ্ছে।
ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীসমাজ জেগে উঠছে এবং নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করছে। ফলে গতানুগতিক সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে এবং তা নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে।
৫. শিল্পায়ন : সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হচ্ছে শিল্পায়ন। শিল্পায়ন মানুষের আয়, পেশা, বাসস্থান, রুচিবোধ, জীবন পদ্ধতি ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে।
মূলত শিল্পায়িত সমাজ অর্থই হলো আধুনিক সমাজ, যা পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।
৬. নগরায়ণ : সামাজিক পরিবর্তনের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হলো নগরায়ণ । নগরায়ণের ফলে মানুষ কৃষি ও গতানুগতিক অকৃষি পেশা ছেড়ে শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদি আধুনিক পেশা গ্রহণ করে।
নগর জীবনযাপনের ফলে মানুষের গোটা জীবনধারণ পদ্ধতিতেই পরিবর্তন আসে। অর্থাৎ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটে এবং মানুষের সাংস্কৃতিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
৭. কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন : মানুষ যখন সনাতনী কৃষি ব্যবস্থা ছেড়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থার পতন করে তখন কৃষি সম্পর্কের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সাধন করে।
বাংলাদেশের কৃষিতে গভীর নলকূপের মাধ্যমে জলসেচ এবং এ লক্ষ্যে সমবায়িক উদ্যোগ সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
৮. বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রভাব : বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে কাজ করে। মহানবি হযরত মুহম্মদ (স.), যিশু খ্রিস্ট, গৌতম বৌদ্ধ প্রমুখ ধর্মগুরু সমাজ পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন।
কার্ল মার্কস, একোলস, লেনিন, মাও সেতুং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের বাহন হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।
তাছাড়া রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
৯. আদর্শ : সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হলো মতবাদ বা আদর্শ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধর্মীয় আদর্শসমূহ এবং উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশ এবং তৎপরবর্তীতে এ মতবাদের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মানবসমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আদর্শ হিসেবে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ভারতবর্ষে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।
১০. সামাজিক পরিকল্পনা : সামাজিক পরিকল্পনা সামাজিক, পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন। সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণসাধনের লক্ষ্যে নতুন নতুন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে।
অর্থাৎ সামাজিক পরিকল্পনা সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করে, অবকাঠামো গঠন করে, শিক্ষার প্রসার ঘটায়। ফলে সমাজ গতিশীল হয় এবং সর্বোপরি আধুনিক সমাজে পরিণত হয়।
১১. জনসংখ্যা : সামাজিক পরিবর্তনের অপর একটি বাহন হলো জনসংখ্যা। কেননা একটি সমাজের জনসংখ্যার প্রকৃতি সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।
জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি, জন্মমৃত্যুর হার, জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের অনুপাত, জনসংখ্যার কর্মসংস্থান প্রভৃতি সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
১২. মনস্তাত্ত্বিক উপাদান : জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক উপাদান সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে বিবেচিত হয়।
কারণ সমাজস্থ মানুষের চিন্তাচেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, আবেগ অনুভূতি, রুচিবোধ প্রভৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক জীবনে নানা পরিবর্তন সাধিত হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজ প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বিভিন্ন পরিবর্তন ও বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ আজকের এ অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
আর সমাজজীবনে কোনো প্রকৃতির পরিবর্তন কী ধরনের বাহন দ্বারা সংঘটিত হবে তা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।
আর সামাজিক পরিবর্তনের বাহন হিসেবে বিশ্বায়ন, বিপ্লব, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, মতবাদ বা আদর্শ, জনসংখ্যা, সামাজিক পরিকল্পনা, এনজিওগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।