পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর
পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর |
পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : পল্লি উন্নয়ন উৎপাদন বৃদ্ধি, সম্পদের সুসমবণ্টন ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনমান উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত পরিবর্তন।
আজকের বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ বিত্তহীনদের, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ মহিলা ও শিশুদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করা এবং সে নিয়ন্ত্রণের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার যথাযথ বণ্টন। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে পল্লি উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
পল্লি উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : নিম্নে পল্লি উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত কর্মসূচি তুলে ধরা হলো :
১. V-AID কর্মসূচি : ১৯৫৩ সালে মার্কিন সরকারের সহায়তায় পল্লি কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন কর্মসূচি ভিলেজ এগ্রিকালচার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট (V-AID) চালু করা হয়।
পাকিস্তান আমলে পল্লি উন্নয়নের স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে এটিই ছিল প্রাথমিক প্রয়াস।
পল্লি উন্নয়নের সকল প্রধান ক্ষেত্র যেমন— কৃষি, প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়ঃরাবস্থা, সমবায়, ভূমি পুনরুদ্ধার, ভৌত অবকাঠামো এবং সামাজিক ও বিনোদনমূলক কর্মকান্ড এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তবে কর্মসূচিটি স্বীয় ভিত রচনায় ব্যর্থ হয়, কারণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও তৃণমূল পর্যায়ে সমাজকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তেমন উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৬১ সালে প্রকল্পটির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করা হয়। ফলে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটে।
২. কুমিল্লা মডেল : পাকিস্তান একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট কর্তৃক ১৯৫৯ সালে কুমিল্লা মডেল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে এর নামান্তর হয়েছে বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)। কুমিল্লা মডেলের চারটি মৌল ভিত ছিল । যথা :
ক. পল্লি কর্মপ্রকল্প স্থানীয় জনশক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পানি নিষ্কাশন প্রণালির উন্নয়ন।
খ. থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র কৃষি, কারিগরি, সমবায়, নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ।
গ. থানা সেচ প্রকল্প : চাষিদের সেচ সুবিধা দান এবং পাওয়ার পাম্প ও টিউবওয়েলের সামষ্টিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা।
ঘ. দ্বিস্তর সমবায় থানা ও মফসাল পর্যায়ে পরিপূরক দুটি সমবায় কাঠামোর মাধ্যমে পল্লির জনগণের মধ্যে সহযোগিতার মানসিকতা সৃষ্টি করা।
৩. সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি : দেশের অন্যান্য অংশে কুমিল্লা মডেলের পুনঃপ্রচলন ও সম্প্রসারণের জন্য ১৯৭২ সালে সরকার সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচিকে তৎপর করে তোলে।
পরবর্তী সময়ে কর্মসূচিটি বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ড নামীয় নতুন এক সংস্থায় রূপান্তরিত হয়। শেষ পর্যন্ত এটি পল্লি উন্নয়নের বৃহত্তম সরকারি সংস্থায় পরিণত হয়। এর প্রধান কাজ হলো পল্লি দারিদ্র্য দূরীকরণ।
উৎপাদনমুখী প্রকল্প গ্রহণ, দ্বিস্তর সমবায়ের ব্যাপ্তি ঘটানো, পল্লি মহিলা প্রকল্প ও দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের মতো টার্গেট গ্রুপভিত্তিক প্রকল্প ও কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন।
৪. স্বনির্ভর আন্দোলন : ১৯৭৫ সালের পর থেকে স্বনির্ভর আন্দোলন কর্মসূচির সূচনা হয়। স্বনির্ভর আন্দোলনের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল স্বাধীনতা ও স্বনির্ভর মতবাদের প্রচলন ঘটিয়ে পল্লি উন্নয়নের প্রশ্নে জনগণের দৃষ্টি থানা থেকে ফিরিয়ে গ্রামে নিবন্ধকরণ, গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের সমন্বয়ে গ্রামসভা নামক প্রতিষ্ঠান গঠন এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পর্কিত অংশীদারিত্বমূলক পতি পরিকল্পনা প্রণয়ন ।
স্বনির্ভর আন্দোলনের বড় ধরনের এক দৃষ্টান্তমূলক প্রকল্প যশোর জেলার উফশী যদুনাথপুর খাল খনন কর্মসূচি। এ কর্মসূচির মাধ্যমে ১৮,০০০ একর জলাভূমিকে চাষাবাদের আওতায় আনা হয় । এজন্য প্রয়োজন হয়েছে দীর্ঘ ৪.২৬ কিমি. সেচ খাল খনন।
৫. নিবিড় পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি : প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় জনগণের আর্থসামাজিক মান উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্যকে সামনে রেখে বার্ড ১৯৭৫ সালে পল্লি উন্নয়ন খাতওয়ারি ধারণা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নিবিড় পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করে।
১৯৯৩ সালে বার্ড একটি পরীক্ষামূলক কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেটি ছিল ক্ষুদ্র চাষি উন্নয়ন কর্মসূচি, যার সকল তৎপরতার লক্ষ্য ক্ষুদ্র কৃষক।
এর উদ্দেশ্য ছিল চাষি ও ভূমিহীন কৃষকদের উৎপাদন ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্তর্বর্তীকালীন সহায়তা ও অন্যান্য সেবা দিয়ে সংগঠিত করা।
৬. বৃহৎ পল্লি উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ : বাংলাদেশে অপরাপর সরকারি বৃহৎ পল্লি উন্নয়ন প্রকল্প হলো দুস্থ শ্রেণির উন্নয়ন প্রকল্প, থানা সম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান প্রকল্প, পল্লি সমাজসেবা কর্মসূচি, সমাজ উন্নয়ন কর্মসূচি, গ্রামীণ মহিলাদের স্বনির্ভর কর্মসূচি এবং পল্লি কর্মসংস্থানবিষয়ক প্রযুক্তি।
৭. সরকারের চলমান পল্লি উন্নয়ন নীতিমালা : বর্তমান সরকারের চলমান পল্লি উন্নয়ন নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কর্মসংস্থানমুখী উৎপাদন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ।
সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে ব্যাপকতর সহায়তা এবং পল্লির দরিদ্র মহিলা, জাতিগত সংখ্যালঘু, শিশু, প্রবীণ প্রবীণা প্রভৃতি পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সব প্রকল্প প্রণয়ন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার পল্লি উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, আয় ও সম্পদের সুসমবণ্টন, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচির মূল্যায়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ প্রভৃতি ৷ বাংলাদেশ সরকার এসব লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছে।