গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা আলোচনা কর
গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা আলোচনা কর |
গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা আলোচনা কর
- অথবা, গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ক্ষুদ্রঋণ হচ্ছে প্রতি ঋণগ্রহীতাকে ১,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রদত্ত জামানতবিহীন স্বল্প পরিমাণ ঋণ।
এ ঋণ প্রধানত কর্মসংস্থান ও আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রম আরম্ভ করার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক ও প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা আধা একরের চেয়ে কম জমির মালিক তাদেরকে প্রদান করা হয়।
ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ অর্থসংস্থানের বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের আয় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে ।
→ গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের গুরুত্ব : ক্ষুদ্রঋণ গ্রামীণ উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছে। নিম্নে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি : মূলত আত্মকর্মসংস্থান, অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মসূচি এবং ব্যবসায়িক কর্মসূচির জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়।
কাজেই বুঝা যায়, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যই হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। গ্রামের দরিদ্র জনগণ দীর্ঘদিন ধরে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।
কিন্তু এ ক্ষুদ্রঋণের ফলে তারা বিভিন্ন ব্যবসায় বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করছে।
২. কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ প্রদান : ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। কেননা ক্ষুদ্রঋণ প্রধানত কর্মসংস্থান ও আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রম আরম্ভ করার উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়।
গ্রামীণ সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে হাঁস-মুরগি, পশুপালন, ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রভৃতি পন্থায় আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে। এভাবে ধীরে ধীরে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে।
৩. শিক্ষার হার বৃদ্ধি : গ্রামীণ দরিদ্রগোষ্ঠী ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রম শুরু করে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতি করছে। যখন তারা তিন বেলা খেতে পারত না তখন সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর কথা চিন্তা করতো না।
কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে তারা তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এভাবে গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্রঋণ ভূমিকা পালন করছে।
৪. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন : ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির ফলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করে।
গ্রামীণ ব্যাংক মূলত - নারীদের ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করতো। নারীরা ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজের বাড়িতে হাস-মুরগি, ছাগলের খামার শুরু করে।
ফলে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। এভাবে ক্ষুদ্রঋণ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে।
৫. পুঁজির যোগান : বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এদের অনেকের ব্যবসায় করার ইচ্ছা রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তারা ব্যবসায়ের পুঁজির ব্যবস্থা করতে পারে না।
গ্রামীণ সমাজে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির ফলে পুঁজি প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে সেটিকে পুঁজি হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে।
৬. বেকারত্ব হ্রাস : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বেকারত্বে হ্রাসে ক্ষুদ্রঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী ৎেকার।
তারা অর্থের অভাবে “কোনো কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে না। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি এসব বেকার জনগোষ্ঠীকে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করছে। ফলে গ্রামীণ সমাজে বেকারত্বের হার হ্রাস পাচ্ছে।
৭. দারিদ্র্য বিমোচন : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্য 'বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। মূলত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের উদ্দেশ্য হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা।
গ্রামীণ সমাজের বড় একটি অংশ জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করছে।
৮. জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি : সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য, খামার স্থাপন প্রভৃতি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের দরিদ্রতা দূর করে আর্থিক উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। ফলে গ্রামীণ সমাজে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯. পশু ও মৎস্য সম্পদের উন্নতি : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে যেসব লোক ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করছে তাদের অধিকাংশই সেই টাকা দিয়ে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল এবং মাছের চাষ শুরু করে।
ফলে তাদের পরিশ্রমের ফলে দিনদিন গ্রামীণ সমাজে মৎস্য ও পশু সম্পদের উন্নয়ন হচ্ছে। কাজেই ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি প্রকৃতপক্ষে পল্লি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
১০. গ্রামীণ মহাজনদের শোষণ থেকে মুক্তি : গ্রামীণ সমাজের দরিদ্র জনগণ দীর্ঘদিন ধরে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বিশেষ করে গ্রামীণ মহাজনদের ওপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।
গ্রামীণ মহাজনগণ অধিকহারে সুদ নিত। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে মহাজন দ্বারা শোষিত হয়ে আসছিল।
গ্রামীণ ব্যাংক সর্বপ্রথম বিকল্প ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে মহাজনদের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি দেশের গ্রামাঞলে বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শামিল করছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণ গ্রামীণ মহাজনদের শোষণ থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করছে।