বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর
বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর |
বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : উন্নয়নমুখী ও গতিশীল প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রশাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে বণ্টন করা হয়।
বিকেন্দ্রীকরণ বলতে প্রশাসনিক ক্ষমতার বণ্টন ও বিভক্তিকরণের নীতিকে বুঝানো হয়ে থাকে । আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারি সেবাকে জনগণের নিকট পৌঁছে দিতে প্রশাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
বিকেন্দ্রীকরণ নীতির দ্বারা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা বজায় রাখা সহজ হয় এবং জটিল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানও সম্ভব হয় ।
● বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্য : নিম্নে বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. নেতৃত্বের বিকাশ : বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নেতৃত্বের বিকাশসাধন। বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণের ফলে প্রশাসন ব্যবস্থায় বহু লোকের সম্পৃক্ততা থাকে।
অঞ্চলভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বিধায় অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ সাধিত হয়। স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্থানীয় সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। আর উন্নয়ন প্রশাসন গড়ে তুলতে এ ধরনের নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।
২. জনকল্যাণ সাধন : জনকল্যাণ সাধন বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ক্ষমতার বণ্টন ও বিভাজন করা হয় ।
এ প্রক্রিয়ায় সরকারি সেবাসমূহকে জনগণের দ্বারে পৌঁছে দেওয়া হয়। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রশাসন ব্যবস্থার গতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং জটিল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চিত হয়।
ফলে সমাজের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয় । বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার মুখ্য উদ্দেশ্যই হলো জনকল্যাণ সাধন ।
৩. স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ : বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসনে ক্ষমতা বণ্টন ও বিভক্তিকরণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধানে স্থানীয় সমস্যার সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
স্থানীয় সমস্যার সমাধানে স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার প্রকৃতি অনুযায়ী সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যা এ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ।
৪. গতিশীলতা বৃদ্ধি : প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা বৃদ্ধি করা বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয়করণ প্রক্রিয়ার ত্রুটি, স্থবিরতা পরিহার করার পক্ষে কাজ করে ।
প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের স্থবিরতা দূর করে দ্রুত স্থানীয় সমস্যার সমাধানই বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্য। বিকেন্দ্রীকরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অঞ্চলভিত্তিক হওয়ায় এর বাস্তবায়নেরও সময় কম লাগে । ফলে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা বাড়ে।
৫. জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ : কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হাতে ন্যস্ত থাকে বিধায় জনগণের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে, বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। কেননা এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন স্থানীয়ভাবে করা হয়ে থাকে।
স্থানীয়ভাবে কর্ম সম্পাদন করতেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়া যায়।
৬. যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ : যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বিকেন্দ্রীকরণে প্রশাসনের গতিশীলতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
প্রশাসন ব্যবস্থায় কর্মসাধনে গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। নয়া সমস্যার ধরন অনুযায়ী নতুন সমাধান পদ্ধতি গ্রহণের জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় ।
সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জটিলতা পরিহার এবং গতিশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৭. দায়িত্বশীল প্রশাসন ব্যবস্থা : দায়িত্বশীল প্রশাসন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য। প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিভক্তিকরণ ও বন্টন দ্বারা নিয়োজিত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা হয়।
স্থানীয় সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব একক নেতৃত্বের ওপর অর্পিত হয় বিধায় এ প্রক্রিয়ার দায়িত্বশীলতা বন্ধুগুণ বৃদ্ধি পায়। বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার চেয়ে সময় ও সম্পদের অপচয় কম হয়।
৮. কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি : প্রশাসনে নিয়োজিত সব ব্যক্তিবর্গের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিকেন্দ্রীকরণ দ্বারা যোগ্য ব্যক্তিকে কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণ সম্ভব হয়।
তাছাড়া সঠিক তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণের ফলে কর্মদক্ষতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এখানে প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত সকলেরই কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
প্রশাসনে নিয়োজিত সকলের কর্মদক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ নিশ্চিত হয় এবং গতিশীল প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
৯. জাতীয় নীতির সাথে সমন্বয়সাধন : জাতীয় নীতির সাথে সমন্বয়সাধন প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় স্থানীয় সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় নীতিনির্ধারণ করা হয়।
জাতীয় ও স্থানীয় নীতির মধ্যে সমন্বয়সাধন ব্যতীত জাতীয় উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় তাই জাতীয় নীতির সাথে স্থানীয় নীতির সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
১০. সংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত : সংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় কেবলমাত্র দায়িত্বই ভাগ করে দেওয়া হয় না, বরং দায়িত্ব পালনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কর্তৃত্বও দেওয়া হয়।
এখানে সংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি মেনে চলা হয়। সংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে প্রশাসনিক কাঠামো তার লক্ষ্যার্জনে সফল হয়।
এছাড়া বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ডেভিড লিলিয়ানখাল (David Lilianthal) তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা :
ক. অঞ্চল বা স্থানীয়ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ,
খ. প্রশাসনে যথাসম্ভব অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও
গ. আঞ্চলিক কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয়সাধন ।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক জনবহুল ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সরকারি সেবাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে বিকেন্দ্রীকরণ সরকারই সর্বোত্তম।
বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ সম্ভব। তাছাড়া যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে প্রশাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।