বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর |
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা বা পশ্চাৎপদ্ধতি বা প্রতিবন্ধকতা আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল হতেই বাংলাদেশের নারীরা রাজনীতি করে আসছে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর হতে রাজনীতিতে নারীর অবস্থান একটু বেশি চোখে পড়ছে।
বাংলাদেশের দুই প্রধান দলের কর্ণধার নারী। তাছাড়া বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তবুও এখনো রাজনীতিতে নারীর অবস্থান সীমিত।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের এ পশ্চাৎপদ অবস্থা স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরেই দৃশ্যমান। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের এ নিম্ন প্রবণতার পশ্চাতে বেশকিছু কারণ দায়ী।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা : বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
নিম্নে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা : বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এখানকার দলগুলো যে প্রার্থী নির্বাচনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারে, তাকেই মনোনয়ন দেয় । অধিকাংশ নারী অর্থবিত্তের অধিকারী নয়।
তাদের নির্বাচনি ব্যয় বহন করার ক্ষমতা নেই। ফলে তারা নির্বাচনের মনোনয়ন পায় না। সুতরাং দেখা যায়, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা নারীর রাজনীতিতে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
২. কালো বা অবৈধ টাকা : আজকাল নির্বাচনি বায় মিটানোর জন্য কালো বা অবৈধ টাকা প্রয়োজন। নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব দেখা যায় । এগুলো আসে অবৈধ পন্থায়। নারীরা এভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারে না।
এজন্য কালোটাকার সংস্থান করতে না পারায় তার নির্বাচনে মনোনয়ন পায় না। সুতরাং দেখা যায়, কালোটাকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের একটি বড় বাধা।
৩. পেশিশক্তির প্রতিবন্ধকতা : বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশিশক্তির প্রভাব ব্যাপক। রাজনীতিবিদগণ টাকা দিয়ে সন্ত্রাসী বা ক্যাডার পোষণ করে। এজন্য সন্ত্রাস ও ধ্বংসের উন্মাদনা নির্বাচনে প্রভৃত প্রভাব বিস্তার করে।
রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহার নারীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ। সুতরাং নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পেল্লিশক্তি একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা ।
৪. জেন্ডার বাধা : বাংলাদেশের নরীরা জেন্ডার বৈষম্যের শিকার। যায়ত্বকে তাদের প্রধান এবং গৃহস্থালিক তাদের অন্যতম কাজ বলে গণ্য করা হয়।
জেন্ডারের এ শ্রম বা কর্মবিভাজন তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পরিপন্থি। কেননা গৃহকর্ম ও সন্তান লালনপালন করে তারা রাজনীতিতে সময় দিতে পারে না। পুরুষকে জেন্ডার বাধার সম্মুখীন হতে হয় না।
৫. নারীর দ্বৈত ভূমিকা পালন : বর্তমানে শিক্ষিত ও সচেতন নারীরা গৃহে ও অফিস আদালতে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা একদিকে ঘরনির কাজ সামলায়। অপরদিকে, তারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অফিসে কাজ করে।
ফলে তারা এ দ্বৈত ভূমিকা পালনের জন্য রাজনীতি চর্চায় পুরুষের মতো সময় নিতে পারে না। এটি তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।
৬. ধর্মীয় গোঁড়ামি : ধর্মীয় গোঁড়ামি নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের একটি প্রতিবন্ধকতা। মৌলবাদীরা নারীর অধীনতায় বিশ্বাসী। তারা নারীর সক্রিয় ও সমতাভিত্তিক অংশগ্রহণের বিরোধী।
কোনো কোনো মৌলবাদী দল প্রকাশ্যে নারীর নিকৃষ্টতা, পুরুষের অধীনতা এবং গৃহবন্দি অবস্থায় বিশ্বাসী ইত্যাদি প্রচার করে। এটি নারীর রাজনীতি করা বা নির্বাচন করার একটি প্রতিবন্ধকতা।
৭. পুরুষের প্রাধান্য : বাংলাদেশের সমাজ পুরুষপ্রধান। তারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে। এদেশের পর্দাপ্রথার প্রাবল্য কমলেও তা একেবারে উঠে যায়নি। এজন্য তারা পুরুষ প্রার্থীকে চেনে না।
তাদের স্বামী বা পুরুষ সঙ্গী তাদের যাকে ভোট দিতে বলে তাকে ভোট দিয়ে চলে আসে। পুরুষের অবাধ্য তারা হতে পারে না। পুরুষের এ প্রাধান্য নারীর রাজনীতিতে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যা।
৮. নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব : বাংলাদেশের নারীরা সচেতন নয়। অনেক শিক্ষিত মহিলারাও রাজনীতি সচেতন নয়। এজন্য তারা রাজনৈতিক নির্বাচনে, দলীয় সভায়, দলীয় কর্মকাণ্ডে, মিটিং ও কনভেনশনে অংশগ্রহণ করতে চায় না।
তারা সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বেশি পছন্দ করে। এজনা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের অভাব লক্ষ করা যায়।
এর মূলে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক চেতনার অভাব। এটি তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা।
৯. শিক্ষার অভাব : বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণে এদেশে নারীশিক্ষার হার অনেক কম।
আর রাজনৈতিক চেতনার অভাবে নারীরা রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন থাকে। রাজনীতি সম্পর্কে তাদের উৎসুক কম। এটি এদেশের নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা।
১০. রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণের অভাব : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণের হার খুবই কম, যদিও দেশের প্রধান দুটি দলের নেতা নারী। দলীয় অন্যান্য পদে নারীর সংখ্যা অত্যন্ত কম।
প্রত্যেক দলের কমিটিতে নারী সদস্যের সংখ্যা খুবই কম। এজন্য যেসব কারণ বিদ্যমান তা হলো নারীর সুযোগের অভাব, তার দ্বৈত ভূমিকা, জেন্ডার বৈষম্য, অনাগ্রহ, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। এসব কারণ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
১১. নারী আন্দোলনের অভাব : বাংলাদেশে নারী আন্দোলন তেমন জোরালো নয়। এখানে ইস্যুভিত্তিক কতকগুলো নারী সংগঠন আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়নের জন্য তেমন চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না।
যেসব নারী রাজনীতি সচেতন তারা বিভিন্ন দলের কর্মী বা দলীয় সহযোগী নারী সংগ কাজ করে। ফলে তারা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এটি তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের একটি বড় সমস্যা।
১২. যোগ্য নারী প্রাণীর অভাব : বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হাতেগোনা কয়েকজন নারী ব্যতীত তেমন কোনো যোগ্য প্রার্থী নেই। বাকি যারা আছেন তারা জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নন।
এজন্য দেখা যায়, সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী নারী সংসদ সদস্যদের সংখ্যা কম। এটি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের অন্যতম একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যা।
১৩. পারিবারিক কারণ : পারিবারিক কারণেও অনেক নারী রাজনীতিতে যোগ দেয় না। বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার রক্ষণশীল । তারা ধর্মীয় কারণ ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চায় না যে, নারী রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করুক।
কোনো নারী রাজনীতিতে অংশ নিতে চাইলেও তার পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই পারিবারিক বাধা নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের একটি বড় অন্তরায়।
১৪, প্রতিকূল পরিস্থিতি : বাংলাদেশের রাজনীতি নারীদের অংশগ্রহণের অনুকূলে নয়। এরূপ প্রতিকূল পরিস্থিতি নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উপযোগী নয়।
গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গুম ইত্যাদি ঘটনা নারীদেরসহ শক্তিমান পুরুষদেরকেও আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে।
এজন্য তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এটি তাদের রাজনৈতিক কার্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের একটি বড় বাধা ।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমান রাজনীতিতে পেশিশক্তি ও কালোটাকার ছড়াছড়ি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
কিন্তু নারীরা সাধারণত এসবের বিপক্ষে এবং তারা এসবের মালিকও নয়। এজন্য রাজনৈতিক দলে পুরুষ সদস্যদের তুলনায় নারী সদস্যদের প্রভাব কম।
ফলে দেখা যায়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই নারীসমাজের জন্য তেমন কোনো কর্মসূচি নেই এবং থাকলেও তা দায়সারা প্রকৃতির।
তাছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে নারী প্রার্থীদেরকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় না। ফলে নারী নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মকাণ্ড তথা রাজনীতির প্রতি নিরুৎসাহিত হয়।