বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপায়সমূহ আলোচনা কর
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপায়সমূহ আলোচনা কর |
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপায়সমূহ আলোচনা কর
- অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপায় বর্ণনা করা।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশে স্বাধীনতা-উত্তর চার দশক সময়ের অর্ধেক সময় সামরিক শাসনামল ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়ার দীর্ঘ রাষ্ট্রপরিচালনায় নারী নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
দীর্ঘ দুই দশকেরও অধিক সময়কাল সরকার ও বিরোধী উভয় দলের প্রধান নারী । সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নারীরাও পুরুষের 'ন্যায় ভোটাধিকার লাভ করেছে।
তারপরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের হার অভ্যন্ত কম। তাই এটি বৃদ্ধির জন্য কতিপয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
• বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপায়সমূহ : নিম্নে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপায়সমূহ আলোচনা করা হলো :
১. জাতীয় সংসদের আসন বৃদ্ধি করা : বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা বর্তমানে ৩৫০টি। এর মধ্যে নারীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে ৫০টি আসন।
এটি জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। এজন্য সংসদে আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে। এটি করতে পারলে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
২. সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধিকরণ : বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০টি করতে হবে এবং নারীরা এতে প্রত্যক্ষভাবে ভোট দিয়ে নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। ফলে দূরে হবে পরোক্ষ নির্বাচনের কুফল। আর এতে নারীদের ক্ষমতায়ন ঘটবে।
৩. নারী আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রবর্তন : জাতীয় সংসদের নারী আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে নারীদের মানমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং তারা কারো দয়ার ওপর নির্ভরশীল হবে না।
নারী আসনে নারী দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বা পপতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। এতে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে।
৪. নারীকে জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান : সাধারণ আসনে নারী-পুরুষ সবাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। এ ব্যাপারে সব দলকে ব্যাপকভাবে নারীর মনোনয়ন দিতে হবে।
ফলে নারী- পুরুষ বাধা দূর হবে এবং নারীরা রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে। এতে দূর হবে নারী-পুরুষ বৈষম্য।
৫. সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন করা : নারী আসনে শুধু নারীরা ভোট দেবে না। পুরুষও ভোট দেবে। এজন্য ভোটাধিকারের ভিত্তি হবে সর্বজনীন।
এটি গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনা করবে। ফলে গণতন্ত্র হবে সংহত ও শক্তিশালী। আর এভাবে রাজনীতিতে নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
৬. দলীয় কাঠামোয় নারীকে উচ্চপদ প্রদান ; বাংলাদেশের দল ব্যবস্থার কাঠামোতে নারীর অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। কোনো দলের প্রেসিডিয়াম বা নীতিনির্ধারণী কমিটিতে দুই একজন নারী থাকলেও অনেক দলের জাতীয় কমিটির অবস্থাও অনুরূপ।
এ কারণে সব রাজনৈতিক দলের কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়বে।
৭. রাজনৈতিক অংশগ্রহণের জন্য নারীকে উদ্বুদ্ধ করা : বাংলাদেশের নারীরা নানা কারণে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী না। এর প্রধান কারণ হলো পারিবারিক বাধা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মৌলবাদী চিন্তাধারা, নারীদের ব্যস্ততা ও অনাগ্রহ।
এসব বাধা দূর করে নারীকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেও ক্রমশ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে।
৮. রাজনৈতিক দলে নারীর দলভুক্তির বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ : নারীরা রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তাদের এ মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য দলে তাদের অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশেষ বাবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এর মধ্যে রয়েছে তাদের দলীয় সদস্য পদ দেওয়া, জেলা, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন কমিটিতে স্থান দেওয়া। এতে তারা রাজনীতি সচেতন হবে।
৯. দলের সব পদে নারীদের অন্তর্ভুক্তকরণ : বাংলাদেশের নারীরা রাজনৈতিক দলে উচ্চপদ পায় না। যারা এসব পদ লাভ করে তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। এজন্য দলীয় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের জন্য তাদের দলীয় কাঠামোর সব স্তরে উচ্চপদ দিতে হবে। এতে তাদের অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পাবে।
১০. নারীর অধিকার নিশ্চিতকরণ : রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি করতে হলে তার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশে নারীর বিরুদ্ধে নানারূপ সহিংসতার ফলে তারা রাজনীতিতে প্রবেশের সাহস পাচ্ছে না। নারী অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে রাজনীতিতে তার পদচারণা বৃদ্ধি পাবে।
১১. নারী আন্দোলন বেগবান করা : রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য দেশে নারী আন্দোলন বেগবান করতে হবে। নারী আন্দোলন বেগবান হলে নারীরা রাজনীতি সচেতন হবে এবং তাদের অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য রাজনৈতিক দলে যোগদান করবে।
দল তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য দরকষাকষি করবে। এ বোধোদয় তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে।
১২. নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা দূর করা : বাংলাদেশে এখনো নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেনি। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য রাজনীতি একটি বড় ফ্যাক্টর, এটি তাদের বুঝাতে হবে। এটি বুঝাতে পারলে তারা তখন দলে দলে রাজনীতিতে যোগদান করবে।
১৩. নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান : শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা এখনো পুরুষের তুলনায় পশ্চাৎপদ। শিক্ষার অভাবে তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ। নারী শিক্ষার জন্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
এতে তাদের শিক্ষার হার বাড়বে এবং তারা রাজনীতি সচেতন হবে। রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে।
১৪. নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকরণ : বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী খুবই দরিদ্র ও সহায়সম্বলহীন। তাদের স্বামীদের আয় নিতান্ত কম। এজন্য তারা মানবেতর জীবনযাপন করে।
তাদের কর্মসংস্থান হলে তারা আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করবে। এদেশের নারীরা দরিদ্র বিধায় তারা রাজনীতি সচেতন নয়। আর্থিক সচ্ছলতা তাদের রাজনীতি সচেতন করতে সাহায্য করবে।
এজন্য দ্রুত নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে রাজনীতি বা রাজনৈতিক অংশগ্রহণে তাদের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।
১৫. পারিবারিক বাধা দূরীকরণ : পারিবারিক বাধা নারীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় বাধা। পরিবার নারীকে রাজনীতি হতে দূরে রাখার চেষ্টা করে। পরিবার মনে করে রাজনীতি পুরুষের কাজ।
নারীদের ঘরে থাকা বাঞ্ছনীয়। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে রাজনীতি হতে দূরে রাখে। তাই এ ধারণা দূর করতে হবে।
১৬. নারীর স্বাধীন ভোটাধিকার প্রদান : এদেশে নারীরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে না। ভোটাধিকার প্রয়োগে তারা স্বামী বা অভিভাবকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
এটি গণতন্ত্র ও নারীর স্বাধীন- মত প্রকাশের পরিপন্থি এবং তাদের রাজনীতিতে উদাসীন করে তোলে। এটি নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধক। তাই ভোটাধিকার প্রয়োগে নারীকে স্বাধীনতা দিতে হবে।
১৭. পেশিশক্তি দমন : পেশিশক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিকে দিনদিন গ্রাস করে ফেলেছে। এর ফলে গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস, ভীতি প্রদর্শন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি শান্তিপ্রিয় নারীদের জন্য হুমকিস্বরূপ ।
এজন্য তারা রাজনীতিতে যোগদানে ভয় পায়। এটি নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বড় বাধা। নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে পেশিশক্তি দমন করতে হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উপরিউক্ত উপায়সমূহ অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও অধিক সংখ্যায় বৃদ্ধি করা সম্ভব।
তবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের জন্য নারীসমাজকেই সচেতন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হতে হবে। সেই সাথে পুরুষের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবেই রাজনীতিতে সার্বিকভাবে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।