বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা আলোচনা কর

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা আলোচনা কর
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা আলোচনা কর

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা আলোচনা কর

  • অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে রাজনীতিতে নারীর প্রভাব বর্ণনা কর । 

উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী কিন্তু শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে রাজনীতিতে এখনো তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। 

তাছাড়া বাংলাদেশে পুরুষতন্ত্র বিদ্যমান থাকায় নারীরা এদেশের জেন্ডার বৈষম্যের শিকার। ধর্মীয় কুসংস্কার, অশিক্ষা, সচেতনতার অভাব নারী স্বাধীনতা ও প্রগতির পরিপন্থি। 

এসব কারণে রাজনীতির বিভিন্ন অঙ্গনে তারা অবহেলিত এবং জনসংখ্যার তুলনায় তাদের অংশগ্রহণ অনেক কম ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা : বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী বিভিন্নভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো : 

১. নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে : বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। এতে নারী-পুরুষ সমানাধিকার লাভ করে। ১৮ বছর বয়সি নারী পুরুষের মতো ভোটাধিকার লাভ করে। 

নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে নারী সরকার পরিবর্তনে অংশ নেয়। নারী নিজেও বিভিন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তাছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও সে তার ভূমিকা পালন করে। 

নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও নারীর ক্ষমতায়ন এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

২. রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে : বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি পরিলক্ষিত হয় রাজনৈতিক দলের সদস্য ও কর্মী হিসেবে নারীর ভূমিকা পালনের মাধ্যমে। 

রাজনীতিতে নারীও যে সচেতন তা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন মিটিং ও মিছিলে নারীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের বড় দলগুলোতে নারীকর্মীর সংখ্যা অনেক। 

আবার প্রত্যেক দলের সহযোগ নারী সংগঠনও আছে। তারা মূল দলের আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যায়। 

৩. রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসেবে : বাংলাদেশ দীর্ঘসময় সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণ থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শীর্ষে অবস্থান করছেন দুজন নারী নেত্রী।

 একজন হলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যজন হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তারা উভয়েই উত্তরাধিকার রাজনীতির হাত ধরে দলের শীর্ষ পর্যায়ে এসেছেন।

৪. জাতীয় সংসদে নারী : বাংলাদেশের আইনসভা জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০ এর মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০। সাধারণ আসনে নারীর সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। 

সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত নারীরা কখনও জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কারণ সরাসরি নির্বাচিত নয় বলে তাদের অবস্থান ছিল বরাবর দুর্বল। 

তবে অনেক নারী সংসদীয় কমিটিগুলোতে কাজ করেছেন এবং আইনসভার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। 

বর্তমান সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেত্রীও নারী। ফলে সংসদে বর্তমানে নারীর অবস্থান মোটামুটি ভালো ।

৫. ক্যাবিনেটে নারী : বাংলাদেশের প্রথম ক্যাবিনেটে কোনো নারী সদস্য ছিল না। ১৯৭২-'৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট মন্ত্রী ছিল ৫০ জন। তার মধ্যে ২ জন ছিল নারী। 

১৯৭৭-৮ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিল ১০১ জন। তার মধ্যে নারী মন্ত্রী ছিলেন ৬ জন। ১৯৮২-৯০ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন ১৩৩ জন। তার মধ্যে নারী মন্ত্রী ছিলেন ৪ জন। 

১৯৯১ '৯৫ সাল পর্যন্ত ২৪ জন মন্ত্রীর, মধ্যে নারী মন্ত্রী ছিলেন ৩ জন। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন ৪৬ জন, যার মধ্যে নারী মন্ত্রী ছিলেন ৪ জন। 

২০০১-০৬ পর্যন্ত ৬০ জন মন্ত্রীর মধ্যে নারী মন্ত্রী ছিলেন ৩ জন। ২০০৮–১৩ মেয়াদে মোট মন্ত্রী হলেন ৪৬ জন। এর মধ্যে নারী মন্ত্রীর সংখ্যা ৬ জন। ২০১৪-'১৮ মেয়াদে ৫৬২ জন মন্ত্রীর মধ্যে নারী মন্ত্রী ৫ জন। 

৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী : বাংলাদেশে নীতিনির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি পুরুষদের কর্তৃত্বাধীনে। তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করে। 

ফলে তারাই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যদিও ১৯৯১ সাল হতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ও দলের শীর্ষে দুজন নারীর আবির্ভাব ঘটেছে। তারা প্রচন্ড প্রভাবশালী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন । 

একজন প্রধানমন্ত্রী ও আরেকজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করলেও সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেনি। তবে ক্রমশ নারীর অবস্থান উন্নত হচ্ছে।4

৭. নেতৃত্ব প্রদানে নারী : ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষপদে কোনো নারী আরোহণ করতে পারেনি। ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দুজন নারী বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষে, ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। 

তারা পর্যায়ক্রমে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের একজন হলেন শেখ হাসিনা ও অপরজন হলেন বেগম খালেদা জিয়া। 

তাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আগমন ও ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান এদেশে নতুন রাজনৈতিক ধারার জন্ম দিয়েছে। 

তারা দুজনই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। জাতীয় নেতৃত্ব প্রদানে তাদের ভূমিকা অসামান্য। তারা দেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখেছেন।

৮. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে নারী : বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছে ১৯৯০ এর দশকে। সেসময় থেকে অদ্যাবধি দেশের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। 

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ডা. দীপুমনি বাংলাদেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তার পূর্বে কোনো নারী পররাষ্ট্র দপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেননি। ডা. দীপুমনি সাফল্যের সাথে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। 

ফলে পরাশক্তির অধিকারী দেশসমূহ, প্রতিবেশী দেশসমূহ, আরব দেশসমূহ, দূরপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।

৯. বেসামরিক প্রশাসনে নারী : বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনেও নারীর অংশগ্রহণের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসনের শীর্ষ পদ হলো সচিব। 

এ পদেও নারীর পদায়ন ঘটছে। শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে একদিন প্রশাসনিক পদে নারীর অংশগ্রহণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছবে। এতে তাদের ক্ষমতায়ন ঘটবে। 

১০. বিচার বিভাগে নারী : বাংলাদেশের বিচার বিভাগেও নারীর অবস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্ন আদালতে অনেক নারী বিচারক আছেন। এখন জেলা জজ পদেও নারী বিচারক কর্মরত আছেন। 

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগেও নারী বিচারপতি আছেন। কিন্তু এখনো প্রধান বিচারপতি পদে কোনো নারী নিয়োগ পাননি। তাই বাংলাদেশের বিচার বিভাগে নারীর অবস্থান এখনো প্রান্তিক।

১১. স্থানীয় সরকারে নারী : বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইউনিটের সর্বনিম্ন স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে মোট ৩টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

১২. পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে নারী : বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর নিম্নপদ হতে উচ্চপদে অনেক নারী কর্মরত। সেনাবাহিনীতে অনেক নারী সৈনিক ও অফিসার পদে কর্মরত আছেন। ফলে নারী-পুরুষ বৈষম্য ক্রমশ কমে আসছে। 

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী উভয়ই নারী । 

তারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে স্বপদে এসেছেন। তাছাড়া ৬ জন নারী মন্ত্রী আছেন। তারা ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। 

তাই বলা যায়, বাংলাদেশে যেকোনো সময়ের চেয়ে রাজনীতিক অঙ্গনে এখন নারীদের পদচারণা বেড়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া চলমান।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ