বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যা আলোচনা কর
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যা আলোচনা কর |
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যা আলোচনা কর
- অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যা বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাত্রা অত্যন্ত কম। গ্রামীণ সমাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সামাজিক সম্পর্ক যেভাবে প্রভাবিত করে রাজনীতি সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
গ্রামীণ জীবনে রাজনীতি গৌণ অংশ। ফলে জাতীয় রাজনীতির সাথে গ্রামীণ সমাজের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। গ্রামীণ সমাজে এলিট শ্রেণি তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা লাভ প্রভৃতি কারণে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যা : নিম্নে গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলো:
১. রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের অধিকাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। গ্রামীণ জনগণের অধিকাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
তারা বৃদ্ধি উৎপাদনসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নিজেদের জীবিকানির্বাহ করে।
ফলে গ্রামীণ জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞানার্জনের কোনো সুযোগ থাকে না। পর্যাপ্ত রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবে গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাত্রা কম
২. গোষ্ঠীতন্ত্র : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে গোষ্ঠী বা বংশের প্রভাব অপরিসীম । গ্রামীণ সমাজে গোষ্ঠীই ব্যক্তির সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করে।
তাই গ্রামীণ সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কোনো জায়গা নেই। গ্রামীণ সমাজে ব্যক্তির পরিবর্তে গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকে পছন্দ করে।
ব্যক্তি গোষ্ঠীর পছন্দের বাইরে অন্য কাউকে পছন্দ করার সুযোগ পায় না। কাজেই গোষ্ঠীতন্ত্র গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অন্যতম সমস্যা।
৩. সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের অভাব : সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে। কেননা অনুকূল পরিবেশে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা সহজতর।
কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক পরিবেশ অনুকূলে নয়। গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এলিট শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ফলে শুধুমাত্র এলিট শ্রেণি তাদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যবহার করে ।
৪. অর্থনৈতিক বৈষম্য : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে সম্পদের সুসমবণ্টন নেই। ফলে সম্পদ সমাজের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত থাকে এবং সাধারণ জনগণ দরিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকে।
এ অর্থনৈতিক বৈষম্য গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করে তোলে। শুধুমাত্র প্রভাবশালী এলিট শ্রেণি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে এবং সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।
৫. নৈরাশ্যবাদী মনোভাব : গ্রামীণ জনগণের চরিত্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো নৈরাশ্যবাদী মনোভাব। গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার অভাবে অধিকাংশ মানুষই কুসংস্কারাচ্ছা এবং নৈরাশ্যবাদী হয়।
তারা রাজনৈতিক পরিবর্তনকে নিজেদের স্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করে না। ফলে তারা রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বিমুখ হয়।
তারা এলিট শ্রেণির শোষণে রাজনীতির প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। কাজেই গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অন্যতম একটি সমস্যা হলো নৈরাশ্যবাদী মনোভাব।
৬. নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগের অভাব : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের প্রায় অর্ধেকই নারী। কাজেই গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু গ্রামীণ সমাজে নারীদের শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজকর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ফলে নারীরা শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায় না।
ফলে তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়, যা গ্রামীণ সমাজের রাজনীতির অন্যতম একটি সমস্যা।
৭. রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অভাব : জাতীয় রাজনীতির সাথে গ্রামীণ মানুষের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। জাতীয় রাজনীতি তাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ করে না। যারা রাজনীতির সাথে জড়িত হয় তারা সাধারণ শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের মানুষ।
একমাত্র নির্বাচন ব্যতীত গ্রামীণ জনগণ জাতীয় রাজনীতির সাথে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হয়. না। ফলে গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। তাই রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অভাব গ্রামীণ সমাজের অন্যতম সমস্যা ।
৮. সচেতনতার অভাব : রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অন্যতম একটি নির্ধারক হলো সামাজিক রাজনৈতিক সচেতনতা। গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার হার খুবই কম।
ফলে গ্রামীণ সমাজের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন নয়। রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবে তারা রাজনীতিকে প্রকৃত অর্থে মূল্যায়ন করতে পারে না।
কাজেই রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে গ্রামীণ সমাজের সংখ্যাধিক্য জনগণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে দূরে থাকে ।
৯. রাজনীতি গৌণ বিষয় : গ্রামীণ সমাজে রাজনীতি হলো জনগণের জীবনের গৌণ অংশ। ফলে জাতীয় নীতিমালা খুব কমই গ্রামীণ জনগণকে প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ করে এবং জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি কর্মই আগ্রহ থাকে।
তাই রাজনৈতিক কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করে গ্রামীণ জনগণের জীবনের খুব সামান্য অংশই ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ রাজনীতি তাদের জীবনের খুব কম অংশ জুড়ে থাকে।
১০. শিক্ষার অভাব : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের বেশিরভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ফলে তারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে দিনরাত সংগ্রাম করে।
তাই অর্থের অভাবে তারা শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। যার কারণে গ্রামীণ জনগণের অধিকাংশই থাকে অশিক্ষিত। এ শিক্ষার অভাব গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রধান সমস্যা।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বহু সমস্যা বিদ্যমান। গ্রামীণ সমাজে শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে অধিকাংশ জনগণ রাজনীতি থেকে দূরে থাকে।
এছাড়া গ্রামীণ সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অভাব, রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব, নৈরাশ্যবাদী মনোভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং নারীদের অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মূল সমস্যা।