বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ আলোচনা কর
বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ আলোচনা কর |
বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ আলোচনা কর
- অথবা, বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ সমাধানের উপায় ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান একটি দেশ। গ্রামই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্যয় হলো পল্লি উন্নয়ন ।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সাথে পল্লি উন্নয়নের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের পল্লি উন্নয়ন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন।
পল্লি উন্নয়নের মাধ্যমে একটি দেশের পল্লির জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য এসব সমস্যার সমাধান করা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের সমস্যা সমাধানের উপায় : বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার : বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ অব্যবহৃত উদ্বৃত্ত প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে ভূমি, পানি, খনিজ সম্পদ প্রভৃতিকে বুঝায়। প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে ভূমি ও পানি সম্পদের যথাযথ ও বৈজ্ঞানিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
২. কৃষি খাতে : বাংলাদেশে মোট ৪.৯৫ কোটি শ্রমশক্তির ৪ কৃষি খাতে নিয়োজিত রয়েছে ৪৮.১০ শতাংশ। কৃষি খাতে এ বিশাল শ্রমশক্তি অদক্ষ ও অধিকাংশই বেকার। এই শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে কৃষির প্রয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ উন্নয়নবান্বিত হবে।
৩. কারিগরি জ্ঞান বৃদ্ধি : দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে অরিরি মনের সম্প্রসারণ করতে হবে। কারিগরি জ্ঞানের রভাবে আমাদের দেশের শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষ কম।
কলকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কারিগরি ও প্রকৌশলগত মনের বাসার মটাতে হবে। এজন্য দেশের গ্রামাঝলে কারিগরি কলেজ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
৪ গ্রামীণ উদ্যোঝা সৃষ্টি : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে উদ্যোজা শ্রেণির অভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কৃষিভিত্তিক কুটিরশিল্প, পোল্ট্রি, q মোটাতাজাকরণ প্রকল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। যা গ্রামীণ বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি গ্রামীণ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
৫. পর্যাপ্ত মূলধন : গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত মূলধন প্রয়োজন। বৃহকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকাণ্ডে উদ্যোক্তাদের ঋণদান করা যেতে পারে।
জনগণের আয়বর্ষনমূলক কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাদের আর ও সময়ে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি যা গ্রামীণ জনগণের মূলধনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
৬. ভূমিসংস্কার : বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার কারণে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ জমি মুষ্টিমেয় জোতদার ও ধনী কৃষকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। ফলে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের পর্যাপ্ত পরিমাণে জমি দিতে পারলে তাদের অর্থনৈতিক- অবস্থার উন্নতি হবে। তারা পল্লি উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশীদার হতে উৎসাহবোধ করবে।
৭. অবকাঠামোগত উন্নয়ন : বাংলাদেশে গ্রামীণ বা পল্লি উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কালভার্ট, গ্রামীণ রাস্তাঘাট প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নসাধনের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব যা গ্রামীণ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
৮. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অধিক জনসংখ্যায় কুফল, পরিকল্পিত পরিবার এবং পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রতি জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৯. কর্মসংস্থান সৃষ্টি : বাংলাদেশের পল্লি উন্নয়নের লক্ষ্যে বেকারত্ব দূরীকরণ অত্যাবশ্যক। এ লক্ষ্যে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ঋণ, জমি বিতরণ, কৃষিভিত্তিক কুটিরশিল্পের সম্প্রসারণ হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, গরু-ছাগল পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের প্রসার ঘটানো জরুরি।
১০. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব দূর করা : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব দূর করে পরি উন্নয়ন প্রক্রিয়া জোরদার করা সম্ভব। এদেশে পল্লি এলাকার উন্নয়ন কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য গড়ে তুলতে হবে।
১১. সৎ ও দক্ষ নেতৃত্ব : পপ্তি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গ্রামাঞ্চলে সৎ ও দক্ষ নেতৃত্বের বিকাশ জরুরি। গ্রামের শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পল্লি উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
১২. বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়সাধন : বাংলাদেশে পরি উন্নয়নে এবং কৃষি উন্নয়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বিএভিসি, পল্লি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা ট্রেনিং ও উন্নয়ন কেন্দ্র, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পল্লি উন্নয়ন কার্যক্রমবিষয়ক সমন্বয়সাধন করতে পারলে পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হবে ।
১৩. সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন : বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ পল্লি উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অদৃষ্টবাদিতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রভৃতি দূর করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনসাধন করতে হবে।
১৪. যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন : বাংলাদেশে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। কারণ কৃষি ও শিল্পের উন্নতি দেশের পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং সুষ্ঠু সমন্বয় করা হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পাশাপাশি পরি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
১৫. সঠিক ও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান : পল্লি উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করতে হবে।
এজন্য বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক জরিপের মাধ্যমে গ্রামীণ সম্পদ, জনশক্তি, বেকারত্বের ধরন ও ভূমিহীনের সংখ্যা, কৃষি ঋণ প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য ও পরিসংখ্যান প্রয়োজন।
১৬. জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ : পল্লি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। দেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিশেষত পল্লি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলে পরি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পল্লি বা গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন দ্রুততর হবে।
পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা জরুরি।
উপরিউক্ত ব্যবস্থাসমূহ যথাযথভাবে কার্যকরী হলে পল্লি উন্নয়নের সকল সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হবে এবং পল্লি উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রসারিত হবে।