উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা কর
উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা কর |
উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ বর্ণনা কর ।
- অথবা, উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য আওতাধীন সম্পদের সুসম বণ্টনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কার্যাবলির সুশৃঙ্খল পদক্ষেপকে পরিকল্পনা বলা হয়। পরিকল্পনা কাজের পূর্বে নির্ধারিত হয় বলে একে পূর্বনির্ধারিত কার্যক্রম বলা হয়।
তবে এটি পূর্বনির্ধারিত কার্যক্রম হলেও এটি কাজের একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবিও বটে। ঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা গেলে শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ : নিম্নে উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : অফুরন্ত চাহিদার মধ্যে থেকে যা অধিকতর প্রয়োজনীয় তা পূরণের জন্য সীমাবদ্ধ সম্পদের ব্যবহার করতে হবে।
অর্থনীতি তখনি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যখন সম্পদের সুসম বন্টন স্থবির হয়ে যায়। তাই রাষ্ট্রকে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
২. জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে রূপান্তর : মানব সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ফলে উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন সম্ভব। উন্নত প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার, তথ্যের অবাধ প্রবাহ বিদ্যমান রাখা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, শিক্ষার সঠিক মান সুনিশ্চিত করা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানব সম্পদ উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব।
৩. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : একটি দেশের উন্নতির প্রধান সোপান হলো, সেদেশের জনসংখ্যাকে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। একমাত্র কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের মানুষ উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে।
কর্মসংস্থান না হলে দেশের বেকার জনগোষ্ঠী বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়ে। উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয় ।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : আধুনিককালে বিশ্বের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির সর্বজনীন স্বীকৃতি রয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে যেসব সমস্যা থাকে সেগুলোর সমাধানের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া দরকার তা কেবল পরিকল্পনার মাধ্যমেই লাভ করা যায়।
৫. কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন : সীমাবদ্ধ সম্পদের সাহায্যে স্বল্প সময়ে দেশের কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নতি ঘটলে নিজ নিজ দেশের জাতীয় উৎপাদন বাড়বে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
৬. জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান : জনসংখ্যাজনিত উদ্ভুত সমস্যাগুলো সমাধানে পরিকল্পিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন । একমাত্র সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ছাড়া জনসংখ্যাজনিত সমস্যাগুলো সমাধান সম্ভব নয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
৭. মূলধন গঠন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনের স্বল্পতা বিদ্যমান। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ভোগ কমিয়ে ও সঞ্চয় বাড়িয়ে মূলধন গঠন ত্বরান্বিত করা যায় ।
৮. আর্থসামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ : রাস্তাঘাট, সেতু, টেলিফোন, বিদ্যুতায়ন, পানি সরবরাহ, স্কুলকলেজ, হাসপাতাল, পার্ক ইত্যাদি অবকাঠামো ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠে না।
কারণ এগুলোর নির্মাণ ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও এগুলো থেকে মুনাফা তেমন আসে না। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগে এগুলো নির্মাণ করা সম্ভব।
৯. আয়ের বৈষম্য হ্রাস : অর্থনৈতিক কল্যাণ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো প্রয়োজন। এজন্য আয় ও সম্পদের সুসম বণ্টন দরকার ।
মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন রোধ করে জনসাধারণের মধ্যে বা কাঙ্ক্ষিতভাবে বণ্টনের জন্য সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। সুসমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমেই এ উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব।
১০. সুসম উন্নয়ন : অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল দেশের সকল অঞ্চলের লোকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন । এজন্য দেশের প্রায় সব অঞ্চলেরই উন্নয়ন অর্থাৎ সুসম উন্নয়ন ঘটানো দরকার। একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই উন্নয়নশীল দেশে সুসম উন্নয়ন সম্ভব।
১১. লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতা দূর : রপ্তানির তুলনায় আমদানি অনেক বেশি হলে বৈদেশিক বাণিজ্য অব্যাহত প্রতিকূলতা বা ঘাটতি দেখা দেয়।
এর ফলে বিদেশের কাছে দেশের ঋণ বাড়ে। কেবল পরিকল্পিত উপায়েই রপ্তানি বাড়িয়ে ও আমদানি কমিয়ে লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতা দূর করা সম্ভব ।
১২. মুদ্রাস্ফীতির চাপ হ্রাস : পৃথিবীর প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশেই মুদ্রাস্ফীতি বিদ্যমান। মূলত চাহিদার তুলনায় দ্রব্য ও সেবাদির ঘাটতিই এ অবস্থার জন্য দায়ী।
এ অবস্থায় একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় কৃষিক্ষেত্রে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করা সম্ভব ।
১৩. একচেটিয়া কারবার নিয়ন্ত্রণ : পরিকল্পিত অর্থনীতিতেই একচেটিয়া কারবারের উদ্ভব রোধ এবং তার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তা সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয় যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে একচেটিয়া কারবার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ।
১৪. মিশ্র অর্থনীতির বিকাশ : বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহঅবস্থান বিদ্যমান।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দুই খাতের ভারসাম্য, উন্নয়ন ঘটলে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে, অপচয় রোধ করা যাবে এবং দেশে মিশ্র অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে ।
১৫. বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস : বিশ্বের অনেক দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল।
এ অবস্থা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদের সমাবেশ ঘটালে ক্রমান্বয়ে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করতে হলে সুষ্ঠু ও সময়োপযুক্ত পরিকল্পনার বিকল্প নেই।
আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য জাতীয়, বার্ষিক, পঞ্চবার্ষিকী এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
পাশাপাশি যেসব কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যাঘাত ঘটে সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাহলেই উন্নয়নশীল দেশের জন্য পরিকল্পনার উদ্দেশ্যাবলি অর্জন করা সম্ভব হবে।