তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ লেখ
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ লেখ |
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ লেখ
- অথবা, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
- অথবা, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কী কী কারণে ব্যর্থ হয়েছিল?
উত্তর : ভূমিকা : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল ছিল ১৯৮৫ সালের ১ জুলাই থেকে ১৯৯০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ পরিকল্পনা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে সত্যিই কিন্তু এরশাদ সরকারের এ পরিকল্পনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির চাপ, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট প্রভৃতি কারণে এ পরিকল্পনার অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
তাছাড়া পরিকল্পনাটি প্রণীত হওয়ার প্রায় নয় মাস পরে চূড়ান্তভাবে এ পরিকল্পনার মেয়াদ শুরু করা হয়। তাই সংগত কারণেই এ পরিকল্পনাটি অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ : বাংলাদেশের তৃতীয় পণবার্ষিকী পরিকল্পনা বহুক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যার্জন করতে পারেনি। এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পিছনে যে সমস্ত কারণ বিশেষভাবে দায়ী তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. আর্থিক লক্ষ্য অর্জিত হয়নি : বাংলাদেশের তৃতীয় পবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এক্ষেত্রে যে ব্যয়বরাদ্দ করা হয় তা অর্জিত না হওয়া।
এ পরিকল্পনায় সরকারি খাতে মোট ব্যয় ধরা হয় ২৫,০০০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি খাতে ১৩,৬০০ কোটি টাকা।
কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেখা যায় সরকারি খাতে ব্যয় হয় ১৭,১২৯ কোটি টাকা যা মোট সরকারি লক্ষ্যমাত্রার ৬৯%।
অপরপক্ষে, বেসরকারি খাতে ১৩,৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা থাকলেও ব্যয় করা হয় ৯,৮৮২ কোটি টাকা শতকরা মাত্র ৭৩%।
সুতরাং দেখা যায়, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী এ পরিকল্পনায় আর্থিক ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় এ পরিকল্পনা অনেকাংশে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২. প্রকৃত জাতীয় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মোট জাতীয় উৎপাদনের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা শতকরা ৫.৪ স্থির করা হয়।
কিন্তু ১৯৮৮ সালের বন্যা ও বেশ কিছু দুর্যোগের কারণে মেয়াদান্তে দেখা যায়, শতকরা মাত্র ৩.৮ ভাগ প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে। যা এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় ।
৩. মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া।
মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেখা যায়, মাথাপিছু আয় মাত্র শতকরা ১.৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে দেখা যায়, সামগ্রিক অর্থনীতি একটি বিরূপ প্রভাব পড়ে। যা এ পরিকল্পনা ব্যর্থতার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
৪. কৃষি উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়া : তৃতীয় পণ্যবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পিছনে বিশেষ কারণ ছিল লক্ষ্যমাত্রানুসারে কৃষি উৎপাদন না হওয়া। এ পরিকল্পনায় কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল শতকরা ৪০ ভাগ।
কিন্তু পরিকল্পনা শেষে দেখা যায়, অর্জিত প্রবৃদ্ধির হার হলো মাত্র শতকরা ১.৪ ভাগ। ফলে অনেকাংশে এ পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
৫. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না হওয়া : বাংলাদেশে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো লক্ষ্যমাত্রানুসারে জনসংখ্যা হ্রাস না পাওয়া।
এ পরিকল্পনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ২.৪ ভাগ থেকে হ্রাস করে ১.৮ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।
কিন্তু মেয়াদ শেষে দেখা যায়; জনসংখ্যা হ্রাস না পেয়ে বরং ২.২ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
৬. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ব্যর্থ : বাংলাদেশের তৃতীয় পণবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে খাদ্য উৎপাদন না হওয়া।
খাদ্য স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পনার শেষ বছরে খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ কোটি ৭ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু মেয়াদ শেষে দেখা যায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
এ পরিকল্পনা মতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। সুতরাং দেখা যায়, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়।
৭. শিল্পখাতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো শিল্পখাতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া। এ পরিকল্পনায় শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল শতকরা ১০.১ ভাগ।
কিন্তু পরিকল্পনা শেষে বাস্তবে অর্জিত প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র শতকরা ৪.২ ভাগ। ফলে দেখা যায়, এ কারণে শেষ পর্যন্ত এ পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি।
৮. আমদানি ও রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থতার পিছনে অন্যতম কারণ হলো আমদানি ও রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া।
এ পরিকল্পনায় ১৪৬৭.৭০ কোটি ডলার দ্রব্যসামগ্রী আমদানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এবং ৫৩৮.৪০ কোটি ডলার মূল্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়।
কিন্তু মেয়াদ শেষে দেখা যায়, দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয় ১৫৪৮.৪০ কোটি ডলার এবং রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৮৪.৪০ কোটি ডলার। আমদানি বেশি, হওয়ায় এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় ।
৯. বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস। এ পরিকল্পনায় মোট ব্যয়ের শতকরা ৫৪ ভাগ বৈদেশিক উৎস হতে পূরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয় কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মেয়াদ শেষে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয় না ফলে এ পরিকল্পনা ব্যাহত হয়।
১০. কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়া। এ পরিকল্পনাকালে ৫১ লাখ অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় ।
কিন্তু বাস্তবে মাত্র ৩৯ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। যাতে ১২ লাখ কর্মসংস্থান লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়। ফলে এ পরিকল্পনা সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তৃতীয় পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনার অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা, দুর্যোগ, দেশীয় সম্পদের ঘাটতি, বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা প্রভৃতি কারণে এ পরিকল্পনা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার মাইলফলকস্বরূপ।