ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর

  • অথবা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর । 
  • অথবা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উন্নয়ন কৌশল উল্লেখ কর।

উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অন্যতম। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো দেশকে মধ্যম অর্থনীতির দেশে পরিণত করার জন্য কিছু উন্নত অর্থনৈতিক কলাকৌশল । 

সাতটি অগ্রাধিকার খাত ও অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিল চূড়ান্ত হওয়ার পর ২২ জুন ২০১১, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের Executive Committee of The National Economic Council (ECNEC) এর বৈঠকে তা অনুমোদিত হয় । তবে এটি কার্যকর করা হয় ২০১১ সালের জুলাই মাস থেকে ।। 

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ : নিম্নে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো : 

১. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এক রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তাই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। প্রযুক্তির উন্নয়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণ, কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানসহ নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন যেকোনো দেশের জন্য কামা। তাই দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অংশ হিসেবে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। 

দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে আয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জনশক্তি রপ্তানি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের প্রসারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

৩. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা : ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন । 

স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা, খাদ্য রপ্তানির সহজ প্রক্রিয়া এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। 

এক্ষেত্রে আবহাওয়া, জলবায়ু ও অভিযোজন প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৃষকদের সাহায্য প্রদান ও উৎসাহ প্রদান।

৪. টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত ব্যবস্থাপনা : উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। 

উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ধারা অব্যাহত রেখে নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়া বজায় রাখা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর একটি। 

পরিবেশের ওপর কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে উন্নয়নসাধন এ পরিকল্পনায় প্রধান পুরুত্ব বহনকারী বিষয়।

৫. আয় সমতা সৃষ্টি করা : যেকোনো ধরনের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আয় বৈষম্য একটি প্রধান অন্তরায়। তাই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আয় সমতা সৃষ্টি করা। 

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ পানি গ্রহণ এবং অত্যাবশ্যকীয় সব চাহিদা মিটানোর জন্য আয় সমতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।

৬. উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার : উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। 

যা দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি ও পরিবেশগত সবক্ষেত্রে সামগ্রিক উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে।

৭. নারী-পুরুষের সমতা : সবসময়ের অত্যন্ত জরুরি আলোচনার ও সমালোচনার বিষয় নারী-পুরুষের সমতা যা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম আলোচ্য বিষয় ও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হাতিয়ার। 

তাই সমাজে সব স্তরে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিতকরণে পঞ্চম ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারীর উন্নয়নের বিষয়টি অত্যন্ত পুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। 

৮. দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পল্লি উন্নয়ন : দারিদ্র্য দূরীকরণে বর্তমান সরকার অনেকাংশে সাফল্য লাভ করলেও এটি এখনো বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ লোক এখনও গ্রামে বসবাস করছে। 

তাই যতগুলো উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লি উন্নয়ন খুব গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টি ষষ্ঠ পণবার্ষিকী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৯. ভূমিহীন ও অসহায়দের জন্য সামাজিক সুবিধা প্রদান : জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক লোক ভূমিহীন ও অসহায় হয়ে সবরকম সামাজিক সুবিধার বাইরে অবহেলিত জীবনযাপন করছে। 

বয়স্ক নাগরিক, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, পথশিশু ও পশ্চাৎপদ নারীদের সেবা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

১০. কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি : কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করার বিষয়টি ষষ্ঠ পণ্যবার্ষিকী পরিকল্পনায় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। 

গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিল্পকে স্থান দেওয়া হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের কৃষিকে শক্তিশালী করা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূলভিত্তি ।

১১. সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণ সুনিশ্চিতকরণ : ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণ সুনিশ্চিতকরণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। সর্বস্তরের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। 

মৌলিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা সুনিশ্চিত করার জন্য সবস্তরের পাশাপাশি Public Private Partnership (PPP) নিশ্চিত করতে হবে।

১২. সীমিত ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার : বর্তমানে ও ভবিষ্যতে কীভাবে সীমিত ভূমিকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় এটি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

ভূমির সঠিক ব্যবহার ও যথাযথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে Gross Domestic Product (GDP) বৃদ্ধি করাই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । 

১৩. প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ : যেকোনো ধরনের উন্নয়ন প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়ন তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের যতটা সম্ভব কম ক্ষতিসাধন করে উন্নয়নের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে । সুস্থ প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনো দেশের মূল্যবান সম্পদ ।

১৪. উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার : ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি দেশের অর্থনৈতিক দিককে শক্তিশালী করার জন্য একটি বৃহৎ পদক্ষেপ যা উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক কার্যকর। তাই এই পরিকল্পনায় উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকে জোর দেওয়া হয় ।

১৫. শক্তিশালী ও জনকল্যাণকর জনপ্রশাসন : শক্তিশালী ও জনকল্যাণকামী প্রশাসনের জন্য মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা ও প্রজ্ঞাশীল ব্যক্তিত্বের কোনো বিকল্প নেই। যা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। 

মেধাভিত্তিক নিয়োগ, কঠোর পরিশ্রমী, উন্নত প্রশিক্ষণ, প্রশাসনের সামর্থ্য বৃদ্ধি ও আচরণবিধি প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। 

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। 

যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জনে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। 

শিক্ষা, সংস্কৃতি, তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ছাড়াও কৃষি, শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে টেকসই উন্নয়ন ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ